সঙ্গীতা ইয়াসমিন –বিশ্বজুড়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরাই দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পরে মহানন্দের ঈদ পালন করে, যা ধর্মীয় বিধান এবং রীতিসম্মত। কালে কালে এই বিধান ধর্মের চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে অধর্মপ্রাণ মুসলিমদের (অচর্চাকারি, কম চর্চাকারী নামেমাত্র মুসলিম) জীবনেও একটি সামাজিক উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।এই ঈদকে কেন্দ্র করে যে উৎসব তা আত্মীয় স্বজনদের পরিবার পরিজনদের মিলন মেলায় পর্যবসিত হয়েছে।এতে করে ঈদের তাত্ত্বিক দিকের কোনো অমর্যাদা কিংবা ঈদ নিয়ে কোনোরূপ অধর্ম হয়েছে বলে মনে হয় না। উপরন্তু, আমাদের চিরায়ত বাংলার সামাজিক বন্ধনের যে ঐতিহ্য, সম্পর্কের যে দৃঢ়তা, সময় আর সুযোগের অভাবে নাড়ীর টানের প্রতি দিন দিন যে শিথিলতা, ঈদ সেই ক্ষয়িষ্ণু সম্পর্কের শূন্যতাকে পূর্ণ করার ক্ষেত্রে এক বিরাট হেতু তৈরি করেছে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

গ্রামে ফেলে আসা পরিবার পরিজনদের কাছে বছরে অন্তত একবার হলেও কষ্ট-ক্লেশ করে ফিরে যাওয়া, একসাথে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেওয়া, সকলের সাথে দীর্ঘ সময়ান্তে দেখা-সাক্ষাৎ হওয়া, সকলের সুখ-দুঃখের খোঁজ খবর নেওয়া এসবই আমাদের ঈদ উৎসবের সাথে সংশ্লিষ্ট। অনেক পরিবারেই বিবাহ অনুষ্ঠানাদিও সম্পন্ন হয়ে থাকে এই ঈদকে ঘিরেই। কারণ, ঈদের দীর্ঘ ছুটিতে সকলকেই একত্রে পাবার সুযোগ মেলে। সুতরাং, ঈদের যে সংস্কৃতি তা আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে সামাজিক জীবনের নানা অনুষঙ্গের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। আমাদের জীবন যাত্রায় নগরায়ণ তথা আধুনিকায়নের প্রভাবের সাথে সাথে ঈদে যে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, তথাপিও ঈদ বাঙালির জীবনে এখনও এক গুরুত্বপূর্ণ মহোৎসব!

পরবাসে ঈদ কেমন হয়? একই সুর-লয়-তালে বাজে কি সেই ঈদের গান? আমরা কি জানি কবে ঈদের চাঁদ ওঠে? “রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” নজরুলের সেই বিখ্যাত গান জানান দেয় পরবাসে? না! এসবের কিছুই হয় না। শেকড়বিহীন পরবাসে গাঁটছড়া বেঁধে অনেককিছুতেই আমাদের আপোষ করতে হয়। পরবাসে ঈদ করতে গিয়ে গত ছয় বছরে সবচেয়ে যে বিষয়টি মনে দাগা দিয়েছে তা হল ‘ঈদের দিন ছুটির দিন নয়’! যদিও অনেক ভালোবাসা, ভালোলাগা, চিরচেনা দেশ, মাটি, বন্ধু-স্বজন ছেড়ে থাকার কষ্টের মতোন এই বেদনাও নিত্যসঙ্গী হয়ে যাবার কথা এতোদিনে! তথাপিও ছয় বছর দিনপঞ্জির পাতায় ছেচল্লিশের থেকে বড় কিছু নয় মোটেই! তাই বড় অনিচ্ছায়ও বুকের ভেতরের খচখচানি থেকেই যায়! ঈদ এলেই মনে পড়ে যায় আমিও মাইনরিটি! আমি পরবাসী! পরগাছা! জোর করে আরেক গাছের ছাল গায়ে লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি! এই ছাল-খাল কিছুই আমার নয়! আমার হলে অন্তত একদিন ছুটিও পেতে পারতাম এই উৎসবে! যেখানে ক্রিস্টমাসে টানা দুই সপ্তাহ ছুটি থাকে, সেখানে ঈদ নীরবে নিভৃতে চরণ চুমে ধুলোয় লুটোপুটি করে চলে যায়, আবার আসবে কোনো এক ছুটির দিনের ফাঁকে, সেই আশা বুকে বেঁধে আমরাও দিন গুণি!

উল্লেখ্য, কানাডায় জনসংখ্যার দিক থেকে ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় অতি অবশ্যই মুসলমানেরা এগিয়ে রয়েছেন, খৃস্টানদের পরেই মুসলিমদের অবস্থান।যেখানে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, গায়ানা, ইন্ডিয়া, ইরান, ইরাক, সৌদি আরব, কেনিয়াসহ আফ্রিকান আরও কয়েকটি দেশের মুসলমান জনগোষ্ঠী মিলে সমগ্র জনগোষ্ঠীর ৩.২% অধিকৃত হয়ে আছে। তবুও, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের চন্দ্র উদয় সংক্রান্ত জটিলতার কারণে সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে ঈদের দিন ছুটি চাহিয়া বাধিতকরণ সম্ভবপর হয় নাই ইত্যবসরে!

এছাড়াও আরেকটি অতি উল্লেখযোগ্যরূপে হাস্যকর বিষয়ের সাথে পরিচিত হয়েছি গেলো বছরগুলোতে, এখানে ঈদ হয় পাড়া-মহল্লাভিত্তিক হুজুরের ফতোয়াবাজীতে! সেটি কেমন? এই ধরুন আমি যে মহল্লাতে থাকি সেখানে একটি মসজিদ আছে, সেই মসজিদের হুজুর সাহেব বয়ান দিলেন ঈদ হবে শুক্কুরবার; আমরা সকলেই হুজুরের মতে মত! জ্বী হুজুর! আমাদের ঈদ শুক্কুরবার! আবার ধরুন, পাশের কমিউনিটিতে এই দশ মিনিটের মত ড্রাইভের দূরত্বে আরেক হুজুর কহিলেন, ধ্যাত মিয়ারা তোমরা ঈদ করিবা আগামী মঙ্গলবার! সেই কমিউনিটির সাধ্যি কী হুজুরের মতের বাইরে যায়? আল্লাহর আলেম বলে কথা! সুতরাং, আমরা পাশের কমিউনিটির বাসিন্দাদের ঈদের দাওয়াত শুক্কুরবারে দিলে তাহারা নিরানন্দে ইফতার করিতে করিতে তাহাদের মঙ্গলবারের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় নিমগ্ন থাকিবেন, ইহাই এইখানকার রেওয়াজ! মানিলে মানিবেন, না মানিলে আপনি বাদ।

যদিও এই শহরেও ইসলামিক ফাউন্ডেশন রয়েছে, আছে চাঁদ দেখা কমিটিও। তথাপিও এই বুজুর্গগণের হাত থেকে আমাদের মত আমজনতার রেহাই নেই। এই পাড়া-মহল্লা ভিত্তিক হুজুরদের ফতোয়াবাজী দেখে মনে পড়ে –একদিন বাঙালি ছিলাম রে…। আমরা জাতীয় জীবন থেকে শুরু করে সমাজের কোনো ক্ষেত্রেই বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় স্বার্থে, সামাজিক, জনগণের স্বার্থে কিংবা ব্যক্তি স্বার্থে কখনোই একমতে উপনীত হতে পারি না। যত ভালো কিছুই হোক না কেন আমাদের বিরুদ্ধাচারণ করতেই হয়। রমজানের শুরুর দিন এবং ঈদ পালনের দিনের এই বিতণ্ডায় আবারও মনে পড়ে যায় পৃথিবীর সকল দেশের হুজুরেরাই একইরকম ফতোয়াবাজ! সেই দিক থেকে আমাদের দেশের আলেমগণের সাথেও বহুত মিল আছে এদের!

পরবাসে যারা ইতোমধ্যে শক্তপোক্তভাবে গাঁটছড়া বেঁধে ফেলেছেন তাঁদের কথাই আলাদা।যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় এই গল্প তাঁদেরকে নিয়ে। একখানা ফুলটাইম চাকরি যারা বাগিয়ে ফেলেছেন, তাঁদের খুব একটা শোক-তাপ নেই এই ঈদের মহাকাব্যে! কেননা এপ্লোয়ী রুলসে ফুলটাইমাররা সবেতনে ছুটি নিতে পারেন একটি নির্দিষ্ট সিলিঙয়ে। আর পার্টটাইমার, ক্যাজুয়াল, কিংবা কন্ট্রাক্ট জবের ছা পোষা কেরানীগণ ছুটি চাইতেই পারেন, ইহাতে এক কার্যদিবসের বেতন কর্তন করা হইবে বলিয়াই বিধান রহিয়াছে! সুতরাং, ঈদ করেগা তো পায়সা নেহি মেলেগা; পায়সা চাহেগা তো ঈদ টুট যায়া! কিয়া কারু?? অগত্যা নুন আনতে পান্তা ফুরানোর জীবনে ঈদের আনন্দও ফ্রিজে তুলে রাখি হপ্তা অন্তে ওভেনে গরম করে খাবো বলে! আর পরবর্তী ছুটির দিনে হাসি হাসি মুখ করে সেজেগুজে ফেজবুকে ছবি আপ্লোড করি, বাসী ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করি।

এই লেখা লিখতে লিখতেই কথা হচ্ছিল কন্যার পিতার সাথে, এ বছর ঈদের ছুটি মেলেনি আমার, তাই সূক্ষ্ম অভিমানে মুখ ভারি তার,কন্যারও একই কথা, মা, তুমিই যখন নেই, তখন স্কুল কামাই করা কেন? আমিও সায় দিলাম তাতে। বললাম, আমি চারটায় ফিরব, ফিরে আমরা কোথাও যাবো। সেও রাজী হয়ে গেল। ঈদে যথারীতি কেনাকাটা নেই, মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার কিছু চাই ঈদের জন্য? সে জানালো, আমার তো অনেক কাপড় আছে, ওর থেকেই একটা পরে নেব। ব্যাস, এইই আমাদের ঈদ! না, অভিযোগ নেই আমার! ছিলও না কখনও! জীবন যখন যেমন দিয়েছে, আঁজলা ভরে নিয়েছি! যা যা পাইনি, তার শূন্যতাটুকুও উপভোগ করেছি জমিয়ে, জেনেছি বেদনা থেকেও অনুপম সুন্দরের জন্ম হয়! সেই সুন্দর আলো ছড়ায়, স্নিগ্ধতা বাড়ায় দিকে দিকে। একদিন সব অসুন্দরের বিরুদ্ধে একাট্টা হবার শক্তি যোগায়।

ঈদের কথা মনে এলেই শৈশবের ঈদ স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বেরিয়ে আসে, গলগল করে অনেক কথাই বেরিয়ে আসতে চায়। আমাদের ছিল এক অন্যরকম শৈশব! আমরা বেড়ে উঠেছিলাম প্রথাবিরোধী, নিয়মতান্ত্রিক, সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ এক মিলিটারি বাবার আর তারও কয়েক ডিগ্রী ওপরে মিলিটারির(মেজাজের) স্ত্রীর তত্ত্বাবধানে! সুতরাং, জীবন আমাদের শৃঙ্খলের গরাদে বন্দী ছিল, আনন্দের থেকে নিরানন্দেই পূর্ণ ছিল বরাবরই।তথাপিও, আজ যেটুকু সহজ আলোয় নিজেকে চিনে নিতে পারি তার সবটুকুন দায় ও দায়িত্ব সেই মিলিটারিগণেরই এ কথা স্বীকার করি অবনত মস্তকে!

অনেকের মতো ঈদে আমরা কোনো ছালামীর টাকা পাইনি কোনোদিন। বাবা-মায়ের কাছে তো নয়ই, এমনকি কোনো আত্মীয় স্বজনদের কাছেও নয়। কেউ দিলেও বাবার কড়া নির্দেশে তা হাত পেতে নেবার সাহস ছিল না। শিশুদের কোমল মস্তিষ্কে টাকার অঙ্ককে বিরাট করে দেওয়াটা বাবা মনে প্রাণে অপছন্দ করতেন।বাবা বলতেন, ওদের যা কিছু দরকার আমরাই কিনে দিই, টাকা যে একটা মূল্যবান দ্রব্য সেসব ওদের মাথায় ঢুকিয়ে এই বয়সেই ওদেরকে লোভী হতে শেখাচ্ছি কি আমরা? এটা কিছুতেই ভালো চর্চা নয়। তাই আশৈশব বন্ধুদের ভ্যানিটি ব্যাগ ভর্তি ছালামীর টাকার গণনা আমসি মুখ করেই দেখে গেছি কেবল, আর মনে মনে ভেবেছি দেখিস একদিন আমিও…!

ঈদে নতুন জামার আবদার করে, জোরেশোরে কান্নাকাটি করার সাহস ছিল না। আমাদের তুলনায় অনেক কম সচ্ছল পরিবারের শিশুরাও যখন ঈদে নতুন কাপড় পেত তখন সত্যিই মন খারাপ হত। করবার মতো হাজারো প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেলেও বাবা-মায়ের অকাট্য যুক্তির কাছে সেসব ছিল নস্যি! বাবার সাফ কথা- ঈদ মানেই খুশি, সকলের সাথে খুশি ভাগাভাগি করার দিন। তোমাদের নতুন কাপড় পরা দেখে অন্য কারো মনকষ্ট হলে সেটা তো খুশি ভাগ করে নেওয়া হল না, তবে কি সেটা করা উচিত যা অন্যকে কষ্ট দেবে? সুতরাং আমাদের অপেক্ষাকৃত কম পুরাতন জামাটি ঘষে মেজে ইস্ত্রি করেই আমাদের ঈদের দিন পরতে হত। তবে আলতা-চুড়ি-ফিতা, কাজল এসব কেনা হত, সবিস্তারে প্রতিবেশী শিশুদের জন্যও কেনা হত। যদিও সেসব ছিল মায়ের মুষ্ঠিচালের দপ্তর! প্রতিবেশীর সন্তানদের আনন্দকে সাথে নিয়ে ঈদ করা মানেই যে প্রকৃত ঈদ এই শিক্ষা ইসলাম দেয় বলেই জেনেছিলাম, যা ছিল আমাদের জীবনের চর্চায়, বইয়ের পাতায় নয়।

আজকাল আমাদের সমাজের বহুল ধর্ম চর্চাকারীদের মধ্যে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি, প্রতিবেশীর দুঃখে দুঃখী হবার বিষয়টি খুব সহজে পরিলক্ষিত হয় না। তবে, শৈশবের সেই কষ্টানন্দের ঈদগুলি পেরিয়ে যতই দিন গেছে আনন্দ যে সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়ার সেটাই বিশ্বাস করতে শিখেছি। আর বাবা- মা ই তো সন্তানের প্রকৃত শিক্ষক। আসুন, আমাদের সন্তানদেরকে লেবাসধারী অন্ধ-বকধার্মিকের ধর্ম চর্চা না শিখিয়ে বরং শেখাই ঈদ মানেই আনন্দ; যা ভাগ করে নিলেই বাড়ে শতগুণে! যে আনন্দে প্রতিবেশী, দরিদ্র, অভুক্তদেরও আছে অধিকার। আমাদের সন্তানদেরকে ধর্মের মূল বার্তাটি পৌঁছে দেওয়ার দায় আমাদেরই! আর সেটা শুরু করি আজই, এখুনি, এই ঈদে।

আমাদের জীবনে আক্ষরিক অর্থেই ঈদ হয়ে উঠুক ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন! ঈদ হোক সুনির্মল! সকলের নিরাপদ, সুন্দর, সুস্থ জীবন তথা পরিবার পরিজন নিয়ে ঈদ উদযাপন করুন সেই প্রত্যাশা রইল। আপনারা ভালো থাকলে ভালো থাকে বুকের গহীনে ঘুমিয়ে থাকা একটি বাংলাদেশ!–সঙ্গীতা ইয়াসমিন, কানাডা প্রবাসী লেখক

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn