রোদ, বৃষ্টি, মেঘলা আকাশ—টন্টনের প্রাত্যহিক সিক্যুয়ালের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে কিংবা মেনেই নিয়েছে বাংলাদেশ দল। তাই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাথায় নিয়েও অনুশীলনে ছেদ পড়েনি। টন্টনে এটাই বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণোদ্যমের অনুশীলন। তিন ঘণ্টার এই সেশনের একের পর এক দৃশ্যাবলি যেন আনন্দ-বেদনায় ভরপুর কোনো ম্যাচেরই প্রতিচ্ছবি! নেটে প্রথমে স্থানীয় এক পেসারের বলে ডান বাহুতে আঘাত খেলেন মুশফিকুর রহিম। তাঁর নেট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্য আঁতকে ওঠার জন্য যথেষ্ট। ঐচ্ছিক অনুশীলনও যিনি মিস করেন না, তিনি সামান্য আঘাতে নেট ছেড়ে দেওয়ার লোক নন। ফিজিওর মুখপাত্র হয়ে তামিম ইকবাল জানিয়েছেন যে, অন্তত আট থেকে বারো ঘণ্টা আগে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না। তাই মুশফিক একদলা উদ্বেগের মেঘ হয়েই আছেন এখনো। আপাতত হাতে আইসব্যাগ ট্রিটমেন্ট চলছে মুশফিকের। তার মানে তাঁকে নিয়ে আতঙ্কে কুঁকড়ে যাওয়ার দরকার নেই।

পাশের নেটেই আবার স্বস্তির হাওয়া, সাকিব আল হাসান নেটে নকিং-টকিং নয়, নিয়মিত নেট করেছেন যে! টন্টনের দৈনন্দিন জীবনে শহুরে ঝাঁজ নেই। তবে এখানকার নেট বোলাররা যেভাবে ব্যাটসম্যানের কানের পাশ দিয়ে শাঁইশাঁই বল নিয়ে যাচ্ছিলেন, তা দেখে মুগ্ধ একটু আগেই প্রথম দফায় ব্যাটিং করে আসা সৌম্য সরকার, ‘এখানকার নেট বোলাররা দারুণ!’ কিন্তু সেই তাঁদেরই একজন, রেনল্ট হুমড়ি খেয়ে পড়তেই থমকে পড়ে নেট এবং পাশেই ফুটবল খেলে গা গরমে ব্যস্ত প্রস্তুতি পর্বের দ্বিতীয় ব্যাচ। মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিনের ড্রাইভের বল সোজা গিয়ে আঘাত হানে নেট বোলারের বাঁ কানের নিচে।

আজকাল বল মাথার আশপাশে লাগলেই ডিপ্রেশনে চলে যায় পক্ষ-বিপক্ষ সবাই। নেট থামিয়ে সেখান থেকেই চিৎকার শোনা যাচ্ছে, ‘তিহান, জলদি আসো!’ বাংলাদেশ দলের ফিজিও তিহান চন্দ্রমোহন নেটে লুটিয়ে পড়া রেনল্টের কাছে যেতে যেতে আইসিসির মেডিক্যাল টিমের সদস্যও হাজির। কিছুক্ষণ শুশ্রূষার পর নেট বোলারটি হেঁটেই ফিরেছেন মেডিক্যাল রুমে। স্বস্তিও ফেরে। তবে স্থানীয় আরেক নেট বোলার দেখি হতাশায় গজগজ করছেন, ‘এই ছেলেটাকে আগে কখনো দেখিনি। কেন যে এই পর্যায়ে বোলিং করতে আসে!’ পাশ থেকে শুনে মাশরাফি বিন মর্তুজা সেই ছেলেটিকে পাল্টা পরামর্শ দেন, ‘খবরদার, ক্রিস গেইলের নেটে বোলিং করতে যেও না!’

এই গেইলের বিপক্ষে সোমবার হয়তো বোলিং করতে হবে মাশরাফিকে। ছোট মাঠে স্বঘোষিত ‘ইউনিভার্স বসে’র মিস হিটগুলোও গ্যালারি উঁচিয়ে বাইরে গিয়ে পড়তে পারে। তবে গেইলরা সাউদাম্পটনে ম্যাচ খেলে গতকালই মাত্র টন্টনে এসে পৌঁছেছে। তাই আর প্র্যাকটিসে আসেনি। তবে দ্বিতীয় দফায় ব্যাটিংয়ে নামা সৌম্যর তুলে তুলে মারা দেখে মনে হলো ‘গেইল চলে এলেন নাকি!’ নাহ, সেই দানবীয় শক্তি তো কোনো বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানেরই নেই। তবে পেস কিংবা স্পিনে সৌম্যর একটার পর একটা তুলে মারা শট সীমানাদড়ির বাইরে গিয়েই পড়ছিল। সেটা দেখে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হবেই যে, মাঠের আকৃতির সুবিধা তো বাংলাদেশও পাবে। কার্ডিফে নিশ্চিত ক্যাচগুলো এ মাঠে ছক্কার হাতছানির প্রতিশ্রুতি দেবে।

এর পরও পাওয়ার হিটিংয়ে ক্যারিবীয়রা নিঃসন্দেহে এগিয়ে। গেইলের সামর্থ্যের বিস্তারিত না বললেও চলে। তবে শুরুতে তাঁর সঙ্গী এভিন লুইস নিজের দিনে গেইলের সমান বিধ্বংসী। দুজনেই বাঁহাতি। তাই সোমবারের ম্যাচে বাংলাদেশের বোলিং শুরুর ছকে অফস্পিন থাকার সম্ভাবনা প্রবল। মেহেদী হাসান মিরাজ আছেন। গতকাল হঠাৎ দেখা গেল মাহমুদ উল্লাহও স্পট বোলিং করছেন! রাউন্ড আর্ম নয়, কাঁধের চোটের কারণে সাইড আর্মে কয়েকটি বল করেই অবশ্য সরে গেছেন তিনি। তাতে অন্তত ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচে মাহমুদের হাতে বল ওঠার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। অবশ্য এতে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। বাঁহাতি লুইসের বিপক্ষে মানসিক লড়াইয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে আমি মনে হয় দুইবার আউট করেছিলাম ওকে’, বলার সময় স্বভাবতই মুস্তাফিজুর রহমানের চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক। তবে ওই সিরিজে লুইসের উইকেট আরো বেশি, তিনবার নিয়েছিলেন মাশরাফি। সাম্প্রতিক বাউটের বিস্তর ব্যবধানে এগিয়ে থাকায় তামিম ইকবাল তো নিজেদেরই ফেভারিট মনে করছেন সোমবারের ম্যাচে। পূর্ণশক্তির ক্যারিবীয় দল, টন্টনের ছোট মাঠ—এসব ক্রমশই বাংলাদেশ দলের আলোচ্য সূচির বাইরে চলে যাচ্ছে সম্ভবত।

তবে টন্টনের মেঘলা আকাশ থেকে যে চোখ সরানো যাচ্ছে না! প্র্যাকটিসের ফাঁকে মাশরাফিই বলছিলেন, ‘এই ম্যাচটিও বৃষ্টিতে বাতিল হলে আমরা শেষ!’ এমনিতেই শ্রীলঙ্কার কাছ থেকে পূর্বপরিকল্পিত পূর্ণ পয়েন্ট পাওয়া হয়নি। তার আগে নিউজিল্যান্ড ম্যাচটিও ফসকে গেছে মুঠো থেকে। তাই সেমির পথটুকু এক ধাপ বেড়ে গেছে বলেই মনে করছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক, ‘নিউজিল্যান্ড ম্যাচটি জিতলে হয়তো ৯ পয়েন্ট নিয়েই সেমিতে যাওয়া যেত। কিন্তু এখন ১১ পয়েন্ট মাস্ট হয়ে গেছে।’ ৩ পয়েন্টের জ্বালানি নিয়ে অত দূর যেতে গেলে পাঁচ ম্যাচের চারটি জিততে হবে বাংলাদেশকে। অধিনায়ক অসম্ভব মনে করছেন না। আর বরাবরের ‘দুঃসাহসী’ ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ প্রায় নিশ্চিত যে, হয়ে যাবে! তবে পূর্বশর্ত হিসেবে অধিনায়কের কাছে তাঁর অনুরোধ, ‘তুই, ওদের একটু চাঙ্গা কর। ওটা তো তুই খুব ভালো পারিস।’

মাশরাফির দলকে চাঙ্গা করার প্রক্রিয়াটা একেবারেই ‘নিজস্ব’। হাসবেন, হাসাবেন এবং একে-ওকে জ্বালাবেন! তবে তাঁর সেই ‘মুড’ থাকাটা জরুরি। গতকাল প্র্যাকটিসের পুরোটা সময় চেনা মুডেই দেখা গেছে তাঁকে। আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগ এবং মাদকবিরোধী বিভাগের দুই কর্মীকে ঠাট্টাচ্ছলে যেভাবে আইসিসির পক্ষপাতের উদাহরণ দিয়ে আক্রমণ করছিলেন, তা অবিশ্বাস্য। বাংলাদেশ অধিনায়ককে তাঁরা ‘অনেস্ট’ বলেছেন, তবে মিছরির ছুরি হয়ে সেসব বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেওয়ার কথা! দেখে-টেখে মনে হলো ড্রেসিংরুমে আবার ফেরত আসছে মনের মেঘ সরানোর উপযোগী মাশরাফি অ্যান্টিক্স!

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn