ইমানুজ্জামান মহী- বেশ কয়েক বছর ধরে ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক খেলা দেখছি। গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলে পরিচিত এ দেশ এখন গণতন্ত্রের ফেরে পড়ে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থায়। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) থাকবে না বেরিয়ে যাবে—এ প্রশ্নে জনগণ আজ দু শিবিরে বিভক্ত। ২০১০ সালের দিকে কঠোর জাতীয়তাবাদী দল ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টি এ নিয়ে প্রথম প্রশ্ন তোলে এবং গণভোটের দাবি জানায়। সে সময় এ দাবি তেমন জোরালো না থাকলেও দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন গণভোটের প্রয়োজনীয়তা মেনে নেন। সিদ্ধান্ত নেন গণভোট অনুষ্ঠানের। ২০১৫ সালে দিলেন গণভোট (রেফারেনডাম)। সে সময় গণভোটের কোনো প্রয়োজন ছিল কি না ব্রিটেনবাসী এখনো সে প্রশ্ন করেন

ইসিতে ব্রিটেনের যোগদান-
টোরি নেতা অ্যাডওয়ার্ড হিথ প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি ব্রিটেন ইউরোপিয়ান কমিউনিটির (ইসি) সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টি জয়ী হলেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। পরে একই সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত মধ্যবর্তী নির্বাচনে সামান্য আসনের ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনে লেবার পার্টির মূল এজেন্ডা ছিল টোরি পার্টির ইসিতে থাকার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য গণভোটের প্রতিশ্রুতি।
১৯৭৫ সালে ৫ জুন নির্বাচনী ওয়াদা রক্ষার্থে লেবার সরকার গণভোটের আয়োজন করে। গণভোটে ৬৭ দশমিক ২ শতাংশ ভোটার ইসিতে থাকার পক্ষে মত দেয়। ১৯৮৩ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে লেবার পার্টি গণভোট ছাড়া ইসি থেকে বের হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যর্থ হয়। সেবারের নির্বাচনে লেবার পার্টি পরাজিত হলে ১৯৮৫ সালে সেই প্রতিশ্রুতি থেকে তারা সরে আসে। টোরি পার্টির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার সে সময় গণভোট ছাড়াই ‘সিঙ্গেল ইউরোপিয়ান অ্যাক্টে’ স্বাক্ষর করেন, যা ‘রোম চুক্তি’ নামে পরিচিত।
১৯৯০ সালের অক্টোবরে রাজনৈতিক চাপের মুখে মার্গারেট থ্যাচার ইউরোপিয়ান এক্সচেঞ্জ রেইট ম্যাকানিজমে (ইআরএম) যোগ দেন। ১৯৯২ সালে সেপ্টেম্বরের কোনো এক বুধবার ইংল্যান্ড ও ইতালি এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে। এতে পাউন্ড ও ইতালির মুদ্রা লিরায় ব্যাপক ধস নামে। এ জন্য এই দিনকে ‘কালো বুধবার’ বলা হয়। পরের বছরের ১ নভেম্বর থেকে ইসি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) হিসেবে পরিচিতি পায়।

ইইউ থেকে ব্রিটেন বের হতে চায়-
সে যাই হোক গণতন্ত্রকে সম্মান জানাতে গিয়ে ২০১৬ সালের জুন মাসে টোরি পার্টির প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন আবার একই ইস্যুতে ‘গণভোট’ দিলেন। গণতন্ত্রের নামে দেশটি এখন এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ওই সিদ্ধান্তের কারণে প্রধানমন্ত্রী নিজে যেমন নেতৃত্ব সংকটে পড়েন, তেমনি দেশটিও পড়ে মহা সংকটে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত ব্রিটেন একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। সংকট থেকে উত্তরণের কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না দেশটি। ক্যামেরনের নিজের সমর্থন ইউরোপের সঙ্গে থাকার পক্ষে হলেও তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের অনেকে নিলেন বিপরীত পক্ষ ‘ব্রেক্সিটের’। গণভোটে পরাজিত হলে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেবেন বলে আগেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য, নিজের জনপ্রিয়তা আরও বাড়ানো। কিন্তু ভোটের পর প্রধানমন্ত্রী পড়লেন বেকায়দায়। এর আগে ২০১০ সালের মে মাসের জাতীয় নির্বাচনে ক্যামেরনের টোরি পার্টি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। নিক ক্লাগের লিবারেল পার্টির সঙ্গে করতে হয় ক্ষমতার ভাগাভাগি, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ডের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো ঘটে। এর আগে ১৯৭৪ সালে প্রথম ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হয়েছিল।
ব্রেক্সিট ইস্যুতে জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে ২০১৬ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে এককভাবে সরকার গঠনের আশা করেছিলেন ক্যামেরন। কিন্তু বাস্তবে প্রধানমন্ত্রীর ‘রিমেইন ক্যাম্পেইনের’ ভরাডুবি হলো; ৫৭ শতাংশ জনগণ চলে গেল ব্রেক্সিটের পক্ষে। শেষ পর্যন্ত নিজের অস্তিত্বের সংকটেই পড়লেন তিনি। কথা মতো পদত্যাগ করলেন দলের নেতৃত্ব ও প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে। সরকার গঠনের এক মাসের মাথায় ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হলো তাঁকে। থেরেসা মে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন। তিন বছরেও থেরেসা মে গণভোটের রায় কার্যকর করতে পারলেন না। বারবার সময়সীমা বাড়ালেন। তিন তিনবার ‘খসড়া ডিল’ আইনসভায় ভোটাভুটিতে খারিজ হয়ে গেল। সর্বশেষ আগামী ৩১ অক্টোবর ব্রেক্সিটের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জে পড়লেন থেরেসা মে। অযোগ্যতা ও ব্রেক্সিট বাস্তবায়নে ব্যর্থতার দায় নিয়ে গত ৭ জুন দলনেতা থেকে তাকে পদত্যাগ করতে হলো তাঁকে।
দলের নেতা নির্বাচন নিয়ে দল পড়েছে এবার আরেক সংকটে। প্রার্থী ছিলেন ১০ জন। নেতা নির্বাচনে দলীয় সাংসদেরা কয়েক দফা ভোটের মাধ্যমে দুজনকে চূড়ান্ত ভোটাভুটির জন্য মনোনীত করেছেন। তৃণমূলের ১ লাখ ৬০ হাজার নেতা-কর্মী এবার পোস্টাল ভোটে এদের একজনকে মনোনীত করবেন। বরিস জনসন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্টের মধ্যে হচ্ছে এ লড়াই; দুজনই মরিয়া। এদিকে প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভাসছে জনগণ। কে হচ্ছেন দলনেতা বা প্রধানমন্ত্রী, তার চেয়ে আসল যে ইস্যু ব্রেক্সিট, তার ভবিষ্যৎ কী হবে, জনগণ তা নিয়েই বেশি চিন্তিত। ইইউ থেকে বের হলে দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজতে পারে বলে কারও কারও ধারণা। কেউ ভাবছেন আবার তার উল্টো। কিন্তু স্পষ্ট ধারণা নেই কারও। কী হবে দেশের ভবিষ্যৎ? চিন্তিত সবাই।
৩ বছরে যে সমস্যার সমাধান পার্টির দায়িত্বশীল নেতারা করতে পারলেন না, নতুন নেতা নির্বাচিত হয়ে তা কি রাতারাতি করতে পারবেন? ২৩ জুলাই জানা যাবে কে হচ্ছেন টোরি পার্টির নেতা ও ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী। দেখা যাক কার গলায় গণতন্ত্রের মালা ঝোলে। গলায় যিনিই মালা পরেন না কেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের সময় পাবেন মাত্র তিন মাস। কারণ ৩১ অক্টোবর ডেডলাইন। সুরাহা করতে হবে এ সময়ের মধ্যেই। আলাউদ্দিনের প্রদীপ নিশ্চয় কারও হাতে নেই। কী হবে তাহলে ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ? ব্রিটেন কি আবার আরেক গণভোটের দিকে এগোচ্ছে? যদি হয়, তবে একে গণতন্ত্রের ফের ছাড়া আর কী বা বলা যেতে পারে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn