বার্তা ডেস্ক :: ‘পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে শিশুদের মাথা লাগবে’ এমন গুজবে দুই সপ্তাহ ধরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা ভেবে এলাকায় অপরিচিত কাউকে দেখলেই পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। শনিবার একই ঘটনা ঘটে ঢাকায়। ‘ঢাকায় নিহত নারীর উদ্দেশ্য ছিল তার সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করা’, বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর থেকেই গণপিটুনির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয় পুলিশ। তদন্ত করা হচ্ছে গণপিটুনির ইন্ধনদাতাদের শনাক্তে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই সপ্তাহে সারাদেশে ২১টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচজন। আহত ২২ জন। শনিবার গণপিটুনিকে ‘ফৌজদারি অপরাধ’ উল্লেখ করে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে একটি বার্তা পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। যেকোনো মূল্যে এই বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে কাজ করছে তারা। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা জাগো নিউজকে বলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে একটি গুজব ছড়ানোকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মর্মান্তিকভাবে কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রবিরোধী কাজের শামিল এবং গণপিটুনি দিয়ে মৃত্যু ঘটানো ফৌজদারি অপরাধ।

তিনি আরও বলেন, ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়ে এ পর্যন্ত যতগুলো নিহতের ঘটনা ঘটেছে পুলিশ প্রত্যেকটি ঘটনা আমলে নিয়ে তদন্তে নেমেছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে ছেলেধরা সন্দেহে কাউকে গণপিটুনি দিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানানো হচ্ছে। গুজব ছড়ানো এবং গুজবে কান দেয়া থেকে বিরত থাকুন। কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিন। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ রোববার (২১ জুলাই) সকালে ছেলেধরা সন্দেহে নওগাঁর মান্দা উপজেলায় ছয় জেলেকে গণপিটুনি দেয় স্থানীয়রা। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলার কুসম্বা ইউনিয়নের বুড়িদহ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

শনিবার রাজশাহীর তানোরে ছেলেধরা সন্দেহে পৃথক স্থানে দুই যুবককে গণপিটুনি দিয়েছে এলাকাবাসী। ওইদিন বিকেলে উপজেলার কলমা ইউনিয়নের বহাড়া ও কামারগাঁ ইউনিয়নের কচুয়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আজ সকালে তাদের আদালতে পাঠানো হয়েছে। শনিবার রাতে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলায় ছেলেধরা সন্দেহে এক যুবককে গণপিটুনির পর পুলিশে দিয়েছে স্থানীয় জনতা। রাত ৮টার দিকে গৌরীপুর ইউনিয়নের হিম্মতনগর বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। শনিবার রাতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ছেলেধরা সন্দেহে রাসেল মিয়া (৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে গণপিটুনির পর পুলিশে দিয়েছে এলাকাবাসী। আটক রাসেলের দাবি, তিনি ফুল ব্যবসায়ী। রাত সাড়ে ৯টায় ফতুল্লার শিহারচর লালখাঁ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এদিন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে দুই ঘণ্টার ব্যবধানে দুজনকে গণপিটুনি দেয়া হয়। এতে একজন যুবক নিহত ও আরেক নারী আহত হন। তবে তাদের গণপিটুনির পরও তারা ছেলেধরা কি-না সে বিষয়ে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। একই দিন ভোরে রাজধানীর উত্তর-পূর্ব বাড্ডায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানকে ভর্তি করতে গিয়ে অভিভাবকদের গণপিটুনির শিকার হন রেনু নামে এক নারী। তার চার বছর বয়সী মেয়েকে স্কুলে দিতে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বাড়ি ফিরেছেন লাশ হয়ে। সন্দেহজনক আচরণের কারণে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাকে।

একই দিন সাভারের ফল ব্যবসায়ী রাসেল মিয়াকে, পাবনায় এক যুবককে, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। এদিন সাভারের তেঁতুলঝোড়া এলাকায় এক শিশুকে বিস্কুট খাওয়ানোর সময় এক নারীকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকায় অপরিচিত হওয়ায় তিন ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়ে আহত ও ১১ জুলাই চাঁদপুরে মনু মিয়া (৪০) নামের একজনকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেয়া হয়। পরে তদন্তে পুলিশ জানতে পারে মনু মিয়া মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি। চালচলনে সন্দেহ হওয়ায় তাকে গণপিটুনি দেয়া হয়। কেন এমন হচ্ছে? জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক (সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক) তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘যেকোনো উন্নয়নকে কেন্দ্র করে মানুষের রক্ত লাগে, শিশুদের মাথা লাগে’ এ ভ্রান্ত ধারণা মানুষের মনে যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। এগুলো যখন গুজব আকারে ছড়িয়ে পড়ে তখন যে কাউকে দেখলেই সন্দেহ করে সাধারণ মানুষ, তাদের সঙ্গে হিংস্র আচরণ করে। মানুষের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর বিশ্বাস না থাকাও গণপিটুনির মাধ্যমে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার একটি অন্যতম কারণ।

এ পরিস্থিতি উত্তরণের বিষয়ে তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যদের সবসময় সতর্ক আচরণ করতে হবে, এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে তৎপর থাকতে হবে। এছাড়া এলাকার নির্বাচিত ও অনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে একটি কমিটি হতে পারে। এলাকায় সন্দেহভাজন কাউকে দেখলে তাকে ধরে কমিটির কাছে এনে যাচাই-বাছাই করা যেতে পারে। এছাড়া স্কুল ও মসজিদভিত্তিক শিক্ষার দিকে জোর দিতে হবে। শিশুদের জানাতে হবে যাতে তারা অভিভাবককে না বলে কারও সঙ্গে কোথাও না যায়। টিভিতে, বিজ্ঞাপন, লিফলেট বিতরণ ও সমাবেশের মতো সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। সৌজন্যে : জাগোনিউজ২৪

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn