নেতাদের দেখে জনগণ শেখে। নেতারা মিথ্যে কথা বললে জনগণও মিথ্যে বলতে শেখে। ভালো মানুষও নেতা বনে গেলে খারাপ হয়ে যায়। সৎলোকও রাজনীতি করতে গিয়ে অসৎ হয়ে যায়। ধর্মীয় নেতারা মগজ ধোলাই করেন, রাজনীতিক নেতা, যাঁরা ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গী করেন, তারাও মগজধোলাইয়ে কম যান না। ধর্মীয় নেতারা মানুষকে পরকালের নরক-বাসের ভয় দেখান। রাজনৈতিক নেতারা ইহকালের জেল-জরিমানার ভয় দেখান। বাংলাদেশে নতুন একটি ভয় শুরু হয়েছে। যে নেতারা দেশ চালাচ্ছেন, তাঁরা ‘ক্রস ফায়ার’ নামে একটা শাস্তি আবিষ্কার করেছেন। এই ক্রস ফায়ার শাস্তিটি যাকে খুশি তাকে দিতে পারবেন নেতারা। নিজেরাই মিডিয়ার রিপোর্ট পড়ে বা টুইটার ফেসবুকের মন্তব্য পড়ে বা লোক মুখে শুনে বা গুজবে কান দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবেন, কে দোষী। তারপর তাকে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরে ফেলবেন, মিডিয়াকে বলে দেবেন, ক্রস ফায়ারে মৃত্যু হয়েছে, মিডিয়াও নিজ স্বার্থে সরকারের গোলামি করবে, বলে দেবে ক্রস ফায়ারে অমুক নিহত। ব্যস মিটে গেল।

না, এভাবে মিটে যায় না। জনগণ শেখে এসব। জনগণ দেখছে বিচারে যাদের জেল হয়, টাকা পয়সা দিয়ে তারা বেরিয়ে যায় জেল থেকে। বড় বড় অপরাধীকে পুলিশ ছোঁয় না। তাঁরা সরকারের ঘনিষ্ঠ লোক বলে ছোঁয় না। জেল-জরিমানা ছোটলোকদের জন্য, বড়লোকদের জন্য নয়। ছোটলোকদের মধ্যেও ছোট বড় আছে, বড়রা জামিন পেয়ে যায়, চটজলদি ছাড়াও পেয়ে যায়। ছোটলোকদের মধ্যে যারা ছোট’র ছোট, তারা অপরাধ না করেও অপরাধী। উকিলকে পয়সা দেওয়ার যাদের পয়সা নেই, জীবনভর জেলে পচে মরা ছাড়া তাদের আর উপায় নেই।

দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি প্রায় কারোরই আস্থা নেই। সরকারেরও নেই। তাই সরকার ক্রস ফায়ারের আয়োজন করে দোষীদের শাস্তি দিচ্ছে। জনগণও তাই করছে। তাদের হাতে বন্দুক থাকলে যাদের তারা দোষী বলে সন্দেহ করছে, তাদের গুলি করে মারছে। যাদের হাতে চাপাতি আছে, তারা চাপাতি দিয়ে খুন করছে তাদের, যাদের অপরাধী বলে সন্দেহ হচ্ছে। চাপাতি না থাকলে, রামদা, রামদা না থাকলে, লাঠি। মানুষ-খুনের মহোৎসব চলছে দেশে।

কাউকে জঙ্গি বলে, মাদক ব্যবসায়ী বলে, খুনি বলে মনে হলে, সরকার যেমন বিশ্বাস করে, বিচারবিহীন মেরে ফেলা যায়; তেমনি জনগণও ভাবে কাউকে চোর বলে, ডাকাত বলে, খুনি বলে, ছেলেধরা বলে সন্দেহ হলে বিচারবিহীন মেরে ফেলা যায়। এই তো সরকার শেখাচ্ছে জনগণকে। কী মুখে সরকার এখন এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করবে? কাউকে ভালো হওয়ার উপদেশ দিলে নিজেকেও ভালো হতে হয়। কাউকে কোনও অপরাধ না করার উপদেশ দিলে নিজেকেও ওই অপরাধ করা থেকে বিরত থাকতে হয়। তা না হলে মানুষ ওই উপদেশ বাণীকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। তাসলিমা রেণুকে যখন খুন করা হচ্ছিল, শুধু কয়েকটি লোক খুন করছিল, তা নয়, ভিড় করে শত শত লোক যারা দেখছিল, তারাও খুন করছিল তাকে। ভিড়ের কারণে তারা সুযোগ পাচ্ছিল না মারার, তা না হলে মারতো। মেরে যে আনন্দ তারা পেত, তা মারের ভিডিও করে সে আনন্দ পেয়েছে। আরও মার, আরও মার বলে বলে যারা মারছে, তাদের উৎসাহ দিচ্ছিল মারার জন্য। এদের মনে মানুষের জন্য মায়া বা মমতা গড়ে ওঠেনি। এদের কোনও যুক্তিবুদ্ধি গড়ে ওঠেনি, এরা আবর্জনার মতো জন্ম নিচ্ছে, আবর্জনার মতো বেড়ে উঠছে। এদের দিয়ে সমাজের ক্ষতি ছাড়া লাভ হওয়ার নয়।

যখন সরকারের অন্যায়গুলো নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের, চিন্তকদের, সমাজ এবং রাজনীতিসচেতন বিজ্ঞদের কোনও রকম প্রশ্ন করার উপায় থাকে না, যখন মুক্তচিন্তা বা বাকস্বাধীনতা বলে যা কিছু আছে, নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তখন সরকার যা করে ভালো করে বা ঠিক করে এরকম একটি বার্তাই পৌঁছয় সবার কাছে। সমাজের আবর্জনাগুলো সরকারের রাস্তাই অনুসরণ করে- যাকে খারাপ লোক বলে সন্দেহ হয়, তাকে মেরে ফেলো।

রাস্তাঘাটে, জনসমক্ষে, শুধু সন্দেহের বশে অথবা পছন্দ হচ্ছে না বলে কাউকে পিটিয়ে মারা, চাপাতি দিয়ে মারা, রামদা দিয়ে মারা, লাঠিসোটা দিয়ে মারা, গুলি করে মারাÑ সবই হই হই করে বাড়ছে। নৃশংসতা দেখে মানুষ প্রজাতি নিয়ে আশংকা হয়। এরা কি আসলেই কোনও শান্তিপ্রিয় প্রজাতি! কোনও দিন কি এই প্রজাতি সুখ শান্তিতে এক পৃথিবীতে বাস করতে পারবে? আজ পর্যন্ত তো পৃথিবীতে শান্তি সৃষ্টি করতে পারেনি এই প্রজাতি, ভবিষ্যতে কি আদৌ পারবে, আমার বিশ্বাস হয় না। সত্যি কথা বলতে, ৭ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে সত্যিকার মানুষ আর ক’জন, আবর্জনার সংখ্যাই কিন্তু বেশি। মানুষ বলতে আমি সভ্য, শিক্ষিত, সংবেদনশীল প্রাণী বুঝিয়েছি। পিটিয়ে পকেটমারদেরও মেরে ফেলে লোকেরা। পুরুষ-পকেটমার সেই ক্ষেত্রে খানিকটা ছোট, খানিকটা দরিদ্র, খানিকটা কালো, খানিকটা সংখ্যালঘু, খানিকটা অসহায় হলে মার দিতে আরাম হয় লোকদের। কিন্তু শিকার নারী হলে সেসব দোষাবলির দরকার পড়ে না। নারী ব্যাপারটিই ছোট, দরিদ্র, কালো, সংখ্যালঘু আর অসহায়। নারী অতি উত্তম ব্যক্তিত্ব হোক, প্রতিভাময়ী হোক, শক্তিময়ী হোক, নারীকে ঘৃণাভরে পেটাতে পারে লোকেরা, নারীকে নির্দ্বিধায় ধর্ষণ করে গলা টিপে মেরে ফেলতে পারে লোকেরা, নারীকে নিয়ে নৃশংসতার চূড়ান্ত করতে পারে লোকেরা। রেণুকে খুন করার মূল উদ্যোক্তা ছিল ১৯ বছর বয়সী হৃদয় নামে এক পাষন্ড তরুণ। শিকার পুরুষ হলে সম্ভবত এতটা বর্বর ওরা হতো না। সমাজ নারীবিদ্বেষী। সমাজের নারীবিদ্বেষ-রোগ সারানোর কোনও উদ্যোগ যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে বা সামাজিকভাবে বা সাংস্কৃতিকভাবে নেওয়া হচ্ছে না, সেহেতু এই আবর্জনাগুলো মহাসমারোহে নারীবিদ্বেষের চর্চা করে চলেছে। এটিকেই তারা ভেবেছে ঠিক কাজ। নারী ডাইনি, নারী কালনাগিনী, নারী নরকের দ্বার, নারী ছেলেধরা, নারী অমঙ্গল, নারী যৌনদাসী, নারী দ্বিচারিণী, নারী বিশ্বাসঘাতিনী- সমাজ এদের মগজে বছরের পর বছর এসবই ঢুকিয়েছে। প্রচলিত ধারণা নিয়ে প্রশ্ন করার চল নেই বলে কেউ প্রশ্ন করে না। সুস্থ বিতর্কের স্থান নেই বলে যুক্তি খাটাচ্ছে না কেউ। হীরক রাজার দেশে হীরক রাজা যেমন খুন করতে ভালোবাসেন, তাঁর সুযোগ্য প্রজারাও তেমন হাসতে হাসতে খেলতে খেলতে খুন করতে ভালোবাসে। অবাক হওয়ার কিছু নেই তো! লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn