ব্র্যাকের চেয়ারপারসন পদ থেকে অবসর নিয়েছেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। মঙ্গলবার প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে এ তথ্য জানানো হয়। তবে ‘চেয়ার ইমেরিটাস’ হিসেবে ব্র্যাকের সঙ্গে থাকছেন তিনি। ব্র্যাকের চেয়ারপারসন হিসেবে যোগ দেবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। এছাড়া ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল আমিরা হক। ব্র্যাকের ওয়েব সাইটে এসব তথ্য জানিয়ে বলা হয়, ৩৬ বছর বয়সে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন স্যার ফজলে হাসান। ৬৫ বছর বয়সে নির্বাহী পরিচালকের পদ থেকে অবসর নেয়ার পর তাকে চেয়ারপারসন নির্বাচিত করে ব্র্যাকের তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ। পরবর্তীতে তিনি ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের তত্ত্বাবধায়ক পর্ষদেরও চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। এবার তিনি ব্র্যাক ও ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল দুটোরই চেয়ারপারসন পদ থেকে অবসর নিলেন। এদিকে ৪৭ ধরে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে থাকা ফজলে হাসান আবেদ পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর কারণ হিসেবে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। কর্মীদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন একটি চিঠিও। সেখানেও  বলেছেন, আমি সবসময় ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে চেয়েছি।

চিঠিতে স্যার ফজলে হাসান আবেদ লেখেন, বিগত কয়েক বছরে আমি ব্র্যাকে আমার পরবর্তী নেতৃত্ব নিয়ে অনেক ভেবেছি এবং সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছি। ব্র্যাকের জন্য এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার, যাতে আমার অবর্তমানেও ব্র্যাক তার শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে পারে। আমি একটি পেশাদার এবং সুশৃঙ্খল পালাবদল নিশ্চিত করতে চাই।  তিনি চিঠিতে লেখেন, ২০০১ সালে যখন ৬৫ বছর পূর্ণ করি আমি তখন ঠিক করলাম, ব্র্যাকের নেতৃত্ব অন্যদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। আমি  নির্বাহী পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করলাম। ব্র্যাকের কাজ পরিচালনার জন্য তখন নতুন একজন নির্বাহী পরিচালক নিয়োগ দেয়া হলো। আমি ব্র্যাকের বোর্ড সদস্য হলাম। সে সময় ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ছিলেন সৈয়দ হুমায়ুন কবীর। তিনি প্রস্তাব করলেন, ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতারই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারপারসন হওয়া উচিত। তখন থেকেই আমি ব্র্যাকের চেয়ারপারসন হলাম। তিনি বলেন, আমার বয়স এখন ৮৩ বছর। আমি মনে করি, চেয়ারপারসন হিসেবে ব্র্যাক এবং ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের বোর্ডের সক্রিয় ভূমিকা থেকে সরে দাঁড়াবার এটিই সঠিক সময়। তাই আমি ব্র্যাক বাংলাদেশের পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল সুপারভাইজরি বোর্ডের চেয়ারপারসনের পদ থেকে অবসর নিচ্ছি। ব্র্যাকের পরিচালনা পর্ষদ আমাকে ব্র্যাকের চেয়ার ইমেরিটাস নির্বাচিত করেছেন। আমি এখনো নিয়মিত অফিসে আসবো। তবে আগামী কয়েক মাস আমি ব্র্যাকের ভবিষ্যৎ কর্মকৌশল এবং পরিচালনা কাঠামো নির্ধারণের বিষয়ে মনোযোগ দেবো।

আগামী দিনের ব্র্যাক কেমন হবে বলতে গিয়ে কর্মীদের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে তিনি বলেন, ব্র্যাক তার যাত্রা শুরু করেছিল ‘বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি’ এই নাম নিয়ে। এখন কেউ আমাকে যখন জিজ্ঞাসা করেন ব্র্যাক মানে কী? আমি তাদেরকে বলি ব্র্যাক শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের নাম নয়, ব্র্যাক একটি স্বপ্ন, একটি প্রচেষ্টা। এটি এমন একটি পৃথিবীর প্রচেষ্টা, যেখানে সব মানুষ তার সম্ভাবনা বিকাশের সমান সুযোগ লাভ করবেন। আগামী ১০ বছরে আমরা আমাদের কাজের প্রভাব পৃথিবীর আরও বেশি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫০ মিলিয়ন মানুষের কাছে ব্র্যাক যেন পৌঁছে যায়, সেটিই আমার প্রত্যাশা। আমি স্বপ্ন দেখি ব্র্যাক আগামীতে আরও বড় হবে, নতুন উদ্ভাবন চালিয়ে যাবে এবং নতুন দিনের প্রয়োজনে নতুন সমাধান নিয়ে এগিয়ে আসবে।

ব্র্যাকের বর্তমান অবস্থানের পেছনে কর্মীদের সবার অবদানের কথা উল্লেখ করে ফজলে হাসান আবেদ লেখেন, আমার একার পক্ষে কখনোই সম্ভব হতো না। জীবনভর যে আস্থা, বন্ধুত্ব, সহযোগিতা, সমর্থন এবং অঙ্গীকার তোমাদের কাছ থেকে আমি পেয়েছি, তার জন্য শুধু ধন্যবাদ দিয়ে তোমাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা বোঝাতে পারবো না। তোমরা তোমাদের সীমাহীন সাহস দিয়ে সবসময় আমার স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে এগিয়ে এসেছো। আনুষ্ঠানিকভাবে ব্র্যাক বোর্ডের চেয়ারপারসন পদ থেকে অবসর নিলেও, আমি তোমাদের পাশেই আছি। আগামী দিনগুলোতে আমি ব্র্যাকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও বিশ্বব্যাপী আমাদের অবস্থান কীভাবে আরও শক্তিশালী করা যায়, তা নিয়ে কাজ করে যেতে চাই। নিজের ব্যক্তিজীবনের কথা জানাতে গিয়ে ফজলে হাসান আবেদ চিঠিতে লেখেন, ১৮ বছর বয়সে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে আমি লন্ডনে চলে যাই। সেটি ছিল ১৯৫৪ সাল। সেই থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত টানা ১৪ বছর আমি লন্ডনেই ছিলাম। সেখানে প্রথমে আমি চার্টার্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউনটেন্ট হিসেবে লেখাপড়া শেষ করলাম। তারপর বেশ কয়েকটি কোম্পানিতে অ্যাকাউনটেন্ট হিসেবে চাকরি করলাম। এক সময় যোগ দিলাম শেল অয়েল কোম্পানির অ্যাকাউন্টস সেকশনে। তরুণ বয়সে এনজিও গড়ে তুলে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে কাজ করবো, এরকম কোনো ভাবনা আমার একেবারেই ছিল না। যথেষ্ট সচ্ছল পরিবেশে আমি বড় হয়েছি। একেবারেই ভিন্ন ধরনের বিলাসী জীবন ছিল আমার। ব্র্যাকের শুরুটা আমার জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়ার গল্প।

প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ছোট্ট একটি ত্রাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে ১৯৭২ সালে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। গত ৪৭ বছরে বিশ্বজুড়ে অন্তত ১১ কোটি মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখার মাধ্যমে ব্র্যাক পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এবং কার্যকর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায়। এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের ১১টি দেশে বিস্তৃত হয়েছে সংস্থাটির কার্যক্রম। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে ব্র্যাকের অ্যাফিলিয়েট কার্যালয় রয়েছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn