বার্তা ডেস্ক:: বরগুনায় রাস্তায় ফেলে প্রকাশ্যে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার চাঞ্চল্যকর ঘটনার প্রধান সাক্ষী ও তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির জামিন আবেদন ফেরত নিয়েছেন তার আইনজীবীরা। বৃহ্স্পতিবার জামিন শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেছেন, মিন্নি ছিলেন রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড। স্বামী রিফাত শরীফের পাশাপশি ‘প্রেমিক’ নয়ন বন্ডের সঙ্গেও শারীরিক সম্পর্ক করতেন মিন্নি। কলেজে যাওয়ার নাম করে নয়নের বাসায় যেতেন মিন্নি। বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে জামিন শুনানি হয়। আদালতে মিন্নির পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না ও ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ অর্ধশতাধিক আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির শুনানি করেন। এ সময় মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর ও রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফও উপস্থিত ছিলেন। বিকাল ৩ টায় আদালত শুরু হলে প্রথমে জামিনের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন মিন্নির আইনজীবী জেড আই খান পান্না। জামিনের বিরোধিতা করে যুক্তি উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির।

এ সময় আদালত জানতে চান, আপনি কী বক্তব্য রাখবেন? কী আছে? জবাবে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, ভিডিও আছে, অনেক কিছুই আছে। আমি আপনাকে জানাচ্ছি। মিন্নির সঙ্গে নয়ন বন্ডের দীর্ঘদিনের প্রণয় ছিল। রিফাতের আগে মিন্নির সঙ্গে নয়ন বন্ডের বিয়ে হয়। সেই বিয়ের তথ্য গোপন করেই মিন্নি রিফাতের সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। নয়ন বন্ড যখন জেলে থাকে তখন মিন্নি তথ্য গোপন করে রিফাত শরীফকে বিয়ে করেন। সেই কাবিননামা আমাদের কাছে রয়েছে। শুধু তাই নয়, নয়ন বন্ড জেল থেকে বের হয়ে আসার পর একসঙ্গে দুটি সম্পর্ক বজায় রাখেন মিন্নি। স্বামীর পাশাপাশি নয়ন বন্ডের সঙ্গেও শারীরিক সম্পর্ক করতেন মিন্নি। কলেজে যাওয়ার নাম করে মিন্নি নয়ন বন্ডের বাসায় গিয়ে মেলামেশা করতেন। এ বিষয়গুলো মিন্নি নিজেই স্বীকার করেছেন তদন্ত কর্মকর্তার কাছে। নিম্ন আদালতে মিন্নির রিমান্ড আবেদনে এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আরও জানান, দুজনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখায় একসময় নয়ন বন্ড ও রিফাতের মধ্যে ঝামেলা তৈরি হয়। পরে মিন্নি ও নয়ন বন্ড মিলে রিফাত শরীফকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। হত্যার উদ্দেশ্যে রিফাতকে কলেজে নিয়ে যান মিন্নি। এর পর তার সামনে রিফাতকে ধরে নিয়ে মারধর শুরু করেন। একপর্যায়ে নয়ন বন্ড কোপাতে থাকলে মিন্নি বাঁচানোর অভিনয় করেন। তিনি বলেন, রিফাতকে কুপিয়ে হত্যার আগে এবং পরে নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির কথোপকথনের রেকর্ড আমাদের কাছে রয়েছে। সেই রেকর্ডে বলা আছে, তারা রিফাত শরীফকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। মিন্নি ও নয়ন বন্ডের ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে কথোপকথনের রেকর্ড আমাদের কাছে রয়েছে। এর পর মিন্নির পক্ষের আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন আদালতে বলেন, এসব ডকুমেন্ট ও ভিডিও তৈরি করা যায়। ভেরিফায়েড কিনা, তা দেখতে হবে। এসব তো মামলার মেরিটের অংশ নয়। আপনি মূল জায়গায় আসেন। এ সময় দুপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে বাদানুবাদ হয়। অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, আপনারা পত্রিকার সংবাদ উপস্থাপন করেছেন। তা কি মামলার নথি? প্লিজ, সাইড টক করবেন না। কোনো কিছু কি জোরপূর্বক আদায় করবেন?

এ সময় আদালত বলেন, কেউ কোনো কিছুই জোরপূর্বক আদায় করতে পারবে না। ফেসবুকের আইডি সঠিক কিনা, তার তো সার্টিফায়েড লাগবে। এ সময় অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, মাই লর্ড, ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, রিফাত শরীফকে যখন ধরে নিয়ে যায়, তখন মিন্নির আচরণ সন্দেহজনক মনে হয়েছে। কেননা কলেজের ফটকে তিনি একবার এসে আবার ভেতরে যান। আবার ফিরে আসেন। রিফাত শরীফকে যখন মারার জন্য ধরে নিয়ে যাচ্ছে তিনি তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। যখন কোপানো শুরু করল তখন বাঁচানোর নামে অভিনয় করেছেন। রিফাতকে কোপানোর সময় বাঁচাতে এলো অথচ মিন্নির শরীরে একটু নখের আঁচড়ও লাগল না। ঘটনার আগে ও পরে বহুবার নয়ন বন্ড এবং মিন্নির সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথোপকথনের রেকর্ড আমাদের কাছে রয়েছে বলেও জানান আইনজীবী। মমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, প্রকৃতপক্ষে মিন্নি ছিলেন রিফাত হত্যার মাস্টারমাইন্ড। মিন্নি নয়ন বন্ডকে বিয়ের তথ্য গোপন করে দুই মাস পর রিফাতকে বিয়ে করেন। বিচারিক আদালত মিন্নির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দির স্বীকারোক্তি, নয়ন বন্ডের সঙ্গে বিয়ের কাবিননামা, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এবং ভিডিও ফুটেজ দেখে জামিন নামঞ্জুর করেন।

এ সময় মিন্নির পক্ষে তার আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন শুনানিতে বলেন, দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে ঘটনা ঘটল। দেশবাসী সবার কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেছে। অথচ কিছু লোককে রক্ষা করার জন্য মিন্নিকে আসামি করা হয়েছে। ঘটনার ১৮ দিন পর সাক্ষীকে আসামিকে করা হলো। আমরা নারী ও অসুস্থ বিবেচনায় তার জামিন চাই। এ সময় আসামিপক্ষের অপর আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী নারীদের জন্য জামিনের ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনার বিধান রয়েছে। এ যুক্তিতে তাঁকে জামিন দেয়া যায়। অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, আইনে থাকলে বাধা নেই। সেক্ষেত্রে রিজনেবল যুক্তি থাকতে হবে। এ সময় মিন্নির আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, পুলিশ কী বলল, সেটা দিয়ে তো এখানে বিচার হবে না। পাবলিক কী বলে সেটা এখানে বিবেচনায় নিতে হবে। তখন আদালত বলেন, আপনাদের কাছে ১৬৪ ধারায় নেয়া জবানবন্দি আছে? জেড আই খান পান্না বলেন, অভিযোগ গঠনের আগে পুলিশ এটা আমাদের দিচ্ছে না। সেটা আমাদের কাছে নেই। এ সময় আদালত বলেন, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি আইনের ৪৯৭ ধারা এখন আমাদের দেশের সামাজিক অবস্থার আলোকে প্রযোজ্য হবে না। ১৬৪ ধারায় নেয়া জবানবন্দি দিতে পারলে আমরা সেক্ষেত্রে জামিনের রুলের বিষয়ে বিবেচনা করব। আপনারা কি আদেশ নেবেন নাকি ফেরত নিবেন? মিন্নির আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, আমরা ফেরত নেব।এরপর আদালত মিন্নির জামিন আবেদন ফেরত দেন। এর আগে গত ৫ আগস্ট মিন্নির জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করা হয়। গত ৩০ জুলাই মিন্নির জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালত।

এর আগে ২২ জুলাই বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে প্রথমবার মিন্নির জামিনের আবেদন করেন আইনজীবী মো. মাহবুবুল বারী আসলাম। ওই দিনই শুনানি শেষে আদালতের বিচারক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম গাজী মিন্নির জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। এরপর গত ২৩ জুলাই ‘মিস কেস’ দাখিল করে বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আসাদুজ্জামানের আদালতে ফের জামিনের আবেদন করেন মিন্নির আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলাম। পরে জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের নথি তলব করে ৩০ জুলাই জামিন শুনানির দিন ধার্য করেন । সেদিনও শুনানি শেষে মিন্নির জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন জেলা ও দায়রা জজ আদালত। ২৬ জুন রিফাতকে বরগুনার রাস্তায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সে সময় স্বামীকে বাঁচাতে মিন্নির চেষ্টার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে আলোচনার সৃষ্টি হয়। পর দিন রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ ১২ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। তাতে প্রধান সাক্ষী করা হয়েছিল মিন্নিকে। পরে মিন্নির শ্বশুর তার ছেলের হত্যাকাণ্ডে পুত্রবধূর জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করলে আলোচনা নতুন দিকে মোড় নেয়। ১৬ জুলাই মিন্নিকে বরগুনার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদের পর এ মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। পর দিন আদালতে হাজির করা হলে বিচারক মিন্নিকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। রিমান্ডের তৃতীয় দিন শেষে মিন্নিকে আদালতে হাজির করা হলে সেখানে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন বলে জানায় পুলিশ। বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত এবং জেলা ও দায়েরা জজ আদালতে মিন্নির জামিন আবেদন নাকচ হয়ে যাওয়ার পর হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন মিন্নি।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn