সাঈদ চৌধুরী টিপু -২০০৩ সালের কথা। বিলকিস নূরের স্বামী আবদুন নূর তখন সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। অনিয়মের অভিযোগে জগন্নাথপুর টিএন্ডটি অফিসে লাইনম্যানের চাকুরি খুইয়েছেন মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। আসা যাওয়ার সুবাদে তার পরিচয় ছিলো আবদুন নূরের সাথে। চাকরি হারিয়ে দিশেহার রতন তখন আয়ের নানা পথ খুঁজছিলেন। তিনিই ডা. আবদুন নূরকে ইন্টারনেট ব্যবসার প্রস্তাব দেন। ডা. আবদুন নূর জানালেন তার কাছে এতো টাকা নেই। নাছোড়বান্দা রতন তবুও পিছু ছাড়েন না।  ডা. আবদুন নূরে কাছে সব মিলিয়ে তখন সতেরো লাখ টাকা। চেয়েচিন্তে আরো তিন লাখ যোগাড় করে ২০ লাখ টাকার ব্যবস্থা করেন আবদুন নূর। শুরু হয় শাহজালাল আইসিটি বিডি লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানের কর্মযজ্ঞ। এই প্রতিষ্ঠানটিই আশিবার্দ হয়ে আসে সুনামগঞ্জ-১ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের সামনে। আর দুঃস্বপ্নের ভিত তৈরি করে আবদুন নূরের পরিবারে। দুঃস্বপ্নের সে গল্পই শোনালেন সুনামগঞ্জের সাবেক সিভিল সার্জন ডা. আবদুন নূরের স্ত্রী শাহজালাল আইসিটি বিডি লিমিটেডের চেয়ারম্যান বিলকিস নূর। যিনি সিলেট জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির দায়িত্বেও আছেন। সরকারি চাকুরে হওয়ায় আবদুন নূরের পক্ষে কোনো প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে যুক্ত থাকার সুযোগ ছিলো না। তাই তার স্ত্রী বিলকিস নূরকে চেয়ারম্যান করার প্রস্তাব দেন মোয়াজ্জেম হোসেন। সে অনুযায়ী লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা হয়। অনুমতি পাওয়ার পর যাত্রা শুরু হয় শাহজালাল আইসিটি বিডি লিমিটেডের। নিজের পরিশ্রমের বিনিময়ে এ প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পান রতন। সিলেট নগরীর শাহজালাল উপশহরের বি ব্লকে জনৈক আজাদুর রহমানের চারতলা বাসায় অফিস ভাড়া নেওয়া হয়। জগন্নাথপুৃরের পাট চুকিয়ে রতন তখন সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে বাসা ভাড়া বকেয়া থাকায়। ভাড়া না পেয়ে বাড়িওয়ালা তাকে আটকে রাখেন। ডা. আবদুন নূরই তাকে ছুটিয়ে আনেন।

শাহজালাল আইসিটি বিডি লিমিটেডের মাধ্যমে শুরু হয় সিলেটের বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ প্রদানের কাজ। প্রথমে টাওয়ার বসানো হয় জগন্নাথপুরেই। একে একে বসে ৬টি টাওয়ার। একেকটি টাওয়ার বসাতে খরচ হয় ১০ লাখ টাকা করে। ব্যবসা তখন কেবলই প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করেছে। তাই ধারদেনা করেই খরচ যোগানো হচ্ছিলো। বিলকিস নূর বললেন, তারা কষ্ট করে অর্থের যোগান দিচ্ছিলেন কিন্তু লাভ হচ্ছিলো শুধু মোয়াজ্জেম হোসেন রতনেরই। নিজেকে বাংলাদেশের আইসিটি ক্ষেত্রে প্রথম নারী উদ্যোক্তা দাবি করে বিলকিস নূর বলেন, প্রতিষ্ঠানটি তখন আমার কাছে একটি স্বপ্নের মতো হয়ে গিয়েছিলো। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে দেওয়াটাকে তিনি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন তাই লাভ না হলেও আর পিছু হটতে পারেননি। কিন্তু রতন বিষয়টি নিজের আখের গোছানোর পথ হিসেবেই নিয়েছিলেন।

এক সন্ধ্যায় বিলকিস নূর যখন তার অফিসে যান শুনতে পান ভেতরে বেশ হইচই। কিছু একটা যে ঘটতে যাচ্ছে তা আগে থেকে আঁচ করেছিলেন তিনি। হইচইয়ের বিষয়টি তার কাছে ভালো মনে হয়নি। তিনি কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে খবর পাঠান তখনকার স্থানীয় সিটি কাউন্সিলর সৈয়দ মিসবাহ উদ্দিনের কাছে। মিসবাহ উদ্দিন অফিসে উপস্থিত হয়ে মুখোমুখি হন মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের। রতন তখন নিজেকে প্রতিষ্ঠানটি বুঝিয়ে দিতে বলেন। রতনের এক সঙ্গী- বিলকিস নূর যাকে বলছেন ছাত্র শিবিরের ক্যাডার, তিনি মিসবাহ উদ্দিনকে ফোন ধরিয়ে বিএনপি নেতা সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলীর সাথে কথা বলতে বলেন। মিসবাহ উদ্দিন রাজি হননি, তিনি নিজেই বিষয়টি সামলানোর দায়িত্ব নেন। ডেকে আনান এলাকার আরো কিছু লোকজনকে। তারা এসে কথাবার্তা বলেন মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের সাথে। কিন্তু রতন ও তার লোকজন কিছুই মানতে রাজি হননি। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে মোয়াজ্জেম হোসেন রতনকে বেঁধে ফেলা হয়। লিমিটেড কোম্পানির এমডি হওয়ায় রতনের বিরুদ্ধে কোনো পুলিশি অ্যাকশনে যাননি বিলকিস নূর। বিলকিস নূর নিজেদের সব উপার্জন খুইয়ে ফেলায় কোম্পানিকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে সিদ্ধান্ত হয় রতন কোম্পানিটি দেখাশোনা করবেন। দুমাস পরে রতন জানালেন কোম্পানিটি তিনি পরিচালনা করবেন না। বাধ্য হয়ে বিলকিস নূর একাই কোম্পানিটির দায়িত্ব কাঁধে নেন। কোম্পানির অবস্থা বুঝতে অডিট করান বিলকিস নূর। ধরা পড়ে বিশাল অনিয়মের। দুই কোটি টাকা দেনা কাঁধে চাপে বিলকিস নূরের। বাসা বাড়ি বিক্রি করে আস্তে আস্তে সে দেনা শোধ করেন তিনি। সিলেট নগরীর কলাপাড়ায় তার চারতলা বাসা ছিলো সেটিও বিক্রি করতে হয়। বিলকিস এখন নূর এখন থাকেন নগরীর শাহজালাল উপশহরের তার ভাইয়ের দেওয়া একটি ফ্ল্যাটে। বিলকিস নূর তার আত্মসাতকৃত অর্থ উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn