বিদেশ ফেরতদের অনিশ্চিত জীবন
নূরে আলম জিকু- ওরা প্রবাসী। রেমিটেন্সযোদ্ধা। এ যোদ্ধারা সংসারে যেমন সচ্ছলতা আনেন, তেমনি দেশের রেমিটেন্সে রাখেন বিরাট ভূমিকা। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে ওরা ভালো নেই। করোনায় আটকা পড়ে যারা প্রবাসে কর্মস্থলে যেতে পারেননি তাদের সামনে এখন গাঢ় অন্ধকার। কারো ভিসার মেয়াদ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে । কারো শেষের পথে। এক অনিশ্চিত জীবনের মুখোমুখি তারা।এমনই একজন মাফু আলম। ভোলার বোরহানউদ্দিন থানায় তার বাড়ি। পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে ৩ বছর আগে আরব আমিরাতে যান মাফু। প্রবাসে কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে গ্রামে বাড়ির কাজ শুরু করেন। মার্চ মাসের প্রথম দিকে ২ মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসেন। ছুটি শেষ হলেও তার আর বিদেশ যাওয়া হয়নি। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে দেশে আটকা পড়েছেন। ভিসার মেয়াদও প্রায় শেষ হওয়ার পথে। মানবজমিনকে তিনি বলেন, বিদেশে অফিসিয়াল চাকরি করতাম। কোম্পানির পলিসি অনেক ভালো ছিল। প্রতি মাসেই দেশে টাকা পাঠাতাম। সেই টাকা দিয়ে গ্রামে একটা নতুন ঘর তৈরি করছি। ২ মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসি। তখনো দেশে করোনা হানা দেয়নি। দেশে এসে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছি। চলার মতো টাকাও নেই। সব স্বপ্নগুলো ভেঙে যাচ্ছে। কোম্পানির সঙ্গে আলাপ করেছি। তারাও আমায় নিতে রাজি। তবে করোনার সংক্রমণ না কমলে নতুন করে এন্ট্রি নিতে পারছি না। এদিকে ভিসার মেয়াদ আছে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এখন কি করবো কিছু বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে দেশে ফেরাই আমার জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছে। এখন ধার-দেনা করে চলছি।
টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরের মো. মিজান। একযুগেরও বেশি সময় ধরে ইতালিতে বসবাস করতেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এক মাসের ছুটিতে দেশে আসেন। এরপর আর ইতালিতে ফেরত যেতে পারেননি। করোনায় দেশে আটকা পড়েন তিনি। মানবজমিনকে তিনি বলেন, ইতালির মিলানো শহরে একটি রেস্টুরেন্টে খাবার সরবরাহের কাজ করতাম। পরিবারের অভাব অনটন থাকায় ধার-দেনা করে বিদেশ গিয়েছিলাম। ধার-দেনা শোধও করেছি। দীর্ঘসময় বিদেশ থাকলেও বেশি টাকা-পয়সা জমাতে পারিনি। ছুটি শেষে যখন বিদেশে ফেরত যাবো, তখনি ইতালিতে করোনার বিস্তার হতে থাকে। তখন আর যাওয়া হয়নি। এরপর দেশেও করোনার বিস্তার ব্যাপক হারে দেখা দেয়। বন্ধ হয়ে যায় বিমান চলাচল। বর্তমানে দেশে থেকে অনিশ্চিত জীবনযাপন করছি। এখন ইতালিতে বাংলাদেশিদের গ্রহণ করা হচ্ছে না। তাই জীবন-জীবিকা নিয়ে শঙ্কিত আমি। মাফু আলম ও মিজানের মতো লক্ষাধিক প্রবাসী দেশে আটকা পড়েছেন।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হিসাবে অনুযায়ী, প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি প্রবাসে বসবাস করছেন। করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর আগেও প্রায় প্রতিদিন ২ থেকে ৩ হাজারের মতো প্রবাসী দেশে ফিরেছেন। তাদের অধিকাংশ আর বিদেশে যেতে পারেননি। প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক সূত্রে জানা যায়, গত ১লা এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত ২৩টি দেশ থেকে প্রায় ৮০ হাজার প্রবাসী কর্মী বাংলাদেশে ফিরেছেন। এর মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ নারী কর্মী। এ সময় সবচেয়ে বেশি কর্মী ফিরেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। করোনার কারণে দেশটিতে বন্ধ হয়ে যায় বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান। সেই সুযোগে ২৫ হাজার ৬৫৩ জন বাংলাদেশিকে ছুটিতে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। মহামারির কারণে মালদ্বীপে কর্মহীন হয়ে পড়েন বহু বাংলাদেশি। গত চার মাসে দেশটি থেকে ফেরত আসছেন ৭ হাজার ৯০৯ জন। আউটপাস নিয়ে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন ১৫ হাজার ৩৮৯ জন, ওমান থেকে ৩ হাজার ৮৮৪ জন, বাহরাইন থেকে ৭৪৬ জন। সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে ১ হাজার ৩৮২ জনকে। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় অবৈধ হয়ে পড়ায় কুয়েতে ৭ হাজার ৩২৯ জন প্রবাসী সাধারণ ক্ষমা পেয়ে বাংলাদেশে আসেন। দক্ষিণ আফ্রিকা, কাতার, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া ও ইরাকে কাজ নেই বলে ১১ হাজার ১৩৩ জন কর্মী দেশে ফিরে আসেন। করোনা মহামারির মধ্যে গত ৬ই জুলাই বাংলাদেশ থেকে ১৫১ জন ইতালির উদ্দেশ্যে গেলেও তাদের সে দেশে নামতে না দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এছাড়া লেবানন থেকে ৯৭৬ জন, রাশিয়া থেকে ১০০ জন, মরিশাস থেকে ২০ জন, তুরস্ক থেকে ১ হাজার ৯৪৮ জন, নেপাল থেকে ৫৫ জন, হংকং থেকে ১৬ জন, কম্বোডিয়া থেকে ৪০ জন ও জাপান থেকে ৮ জন প্রবাসী কর্মী দেশে ফেরত এসেছেন। কাজের মেয়াদ শেষ হওয়ায় ভিয়েতনাম থেকে ফিরেছেন ১২২ জন এবং শ্রীলঙ্কা থেকে ৮০ জন।
এরকম একজন নারায়ণগঞ্জের আমজাদ হোসেন। গত জানুয়ারিতে ২ মাসের ছুটি নিয়ে ইতালি থেকে বাংলাদেশে আসেন। করোনাভাইরাসের কারণে দেশে আটকা পড়ে আর স্বপ্নের ইতালি ফেরা হয়নি। বহুবার চেষ্টা আর টিকিট কাটলেও প্রিয় কর্মস্থলে ফিরতে পারেননি। মানবজমিনকে বলেন, ছুটি শেষে যে সময় ইতালিতে ফিরত যাবো, তখনি ইতালিতে লকডাউন শুরু হয়। চলতি মাসের ১৪ তারিখে ইতালি যাওয়ার কথা থাকলেও যেতে পারিনি। বাংলাদেশিদের এখন গ্রহণ করা হচ্ছে না। ফ্লাইট বন্ধ। দেশে গত ৭টি মাস বেকার হিসেবে বেঁচে আছি। আমার মামা শ্বশুর ইতালিতে ব্যবসা করেন। তিনিও দেশে এসে এখন বিপদে পড়েছেন। তার ব্যবসা দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ। দিন যতই যাচ্ছে, আমাদের মতো প্রবাসীদের চিন্তা বেড়েই চলছে। আমাদের জীবন এখন অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। কারোনাকালীন সময়ে বাহরাইন থেকে দেশে ফিরছেন জয়দেব চন্দ্র দে। তিনি জানান, বাহরাইনে একটি মোবাইল কোম্পানিতে সেলসম্যানের চাকরি করতেন। করোনাকালীন সময়ে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় নতুন করে ভিসা লাগিয়ে ছুটিতে দেশে আসেন। এখন আর যেতে পারছেন না। ছুটি শেষ হওয়ার আগেই বাহরাইনে যোগাযোগ করা হলে, তারা আমাকে এখন যেতে না বলছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ওই কোম্পানিতে যোগ দিতে পারবো না বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এদিকে গত ৪ মাস ধরে দেশে অবস্থান করছি। দিন যত যাচ্ছে, ততই মনে হচ্ছে বিপদ বাড়ছে। এভাবে আর কতদিন যাবে জানি না। চোখে মুখে অন্ধকার দেখছি। এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো সহযোগিতা পাইনি। কেউ খোঁজও নেয়নি।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপুলসংখ্যক প্রবাসী দেশে আটকে পড়ায় রেমিটেন্সের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। অনেক প্রবাসীর ভিসা, পাসপোর্টসহ কাগজপত্র ঠিক থাকলেও বিদেশ যেতে পারছেন না। করোনাভাইরাসের কারণে অনেক দেশ জনবল নিতে চাচ্ছে না। ফলে দেশে আটকে পড়া প্রবাসীদের দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও ভীতির মধ্যে দিয়ে দিন কাটছে। পরিবারের ভরণ-পোষণ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। এখন অনিশ্চতয়ার মধ্য দিয়েই তাদের জীবন কাটাতে হচ্ছে। অনেকেই ধার-দেনা করে বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলেও যাওয়ার সুযোগ মিলছে না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দেশের মানুষকে সরকার যেভাবে মানবিক সহায়তা দিচ্ছেন, ঠিক তেমনি প্রবাসীদেরকেও দেয়া উচিত। একই সঙ্গে দেশে এসে আটকা পড়া এই কর্মীদের যাতে আবার ফেরত পাঠানো যায়, সেজন্য কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে। সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে এদেরকে বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিলে বিপুলসংখ্যক আটকে পড়া প্রবাসীর মুখে হাসি ফুটবে এবং দেশে রেমিটেন্স আসাও স্বাভাবিক গতি পাবে। অন্যথায় দেশে বেকারত্ব আরো বেড়ে যাবে। এদিকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা- আইওএম দেশের ১২ জেলায় বিদেশ ফেরত অভিবাসীদের ওপর গবেষণা করে জানায়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে বিদেশ ফেরতদের জীবিকাহীন অবস্থায় আছেন প্রায় ৭০ শতাংশ। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অপরিকল্পিত ও ব্যাপক সংখ্যক জীবিকাহীন অভিবাসী কর্মী ফেরত আসায় সারা দেশে রেমিটেন্সনির্ভর জনগোষ্ঠীর উপরও বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগ বিদেশ ফেরত অভিবাসী কর্মীদের জীবন ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব নিয়ে একটি জরিপ চালায়। জরিপ থেকে জানা যায়, কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির সময়ে দেশে ফেরত আসা অভিবাসী কর্মীদের ৮৭ শতাংশেরই কোনো আয়ের উৎস নেই। প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও ভীতির মধ্যে রয়েছেন ৭৪ শতাংশ। ৩৪ শতাংশ জানান, তাদের নিজেদের সঞ্চয় বলতে এখন আর কিছু নেই। ৯১ শতাংশ বলেছেন, তারা সরকারি বা বেসরকারি কোনো সহায়তা পাননি। ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসানের মতে, দেশে আটকা পড়া বাংলাদেশিরা যেন সরকারের জরুরি সহায়তা পায়, সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে করোনার কারণে চাকরিচ্যুত হয়ে কিংবা অন্য কোনো কারণে বিদেশফেরত কর্মীদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের অনুকূলে ৫০০ কোটি টাকার বরাদ্দ অনুমোদন করা হয়েছে। এছাড়া প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্পসুদে ও সহজ শর্তে বিনিয়োগ ঋণ প্রদানের জন্য ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে ২০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়েছে। তবে এই ঋণ নিয়ে প্রবাসীরা আসলেই ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন কিনা তা নিয়েও শঙ্কা আছে। অভিবাসীদের অধিকার বিষয়ক সংগঠন ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক মানবজমিনকে বলেন, প্রবাসীরা দেশে আটকা পড়ার আশঙ্কা বেড়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে ৭-৮ মাস ধরে দেশে আটকে আছেন অনেকেই। তাদের বিদেশে ফেরত যাওয়ার সুযোগ আসলেও, করোনা টেস্টের কারণে অনেকেই যেতে পারছেন না। এছাড়া টিকিটের উচ্চমূল্য। অনেকেই আর বিদেশে ফেরত যেতে পারবেন না। কারণ তাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। করোনা সংক্রমণের কারণে কপিলরাও এখন শ্রমিক দিতে চাচ্ছে না। এদিকে অনেকেই ধার-দেনা করে বিদেশ গিয়েছেন। তাদেরকে ছুটিতে কিংবা ফেরত পাঠানো হয়েছে। এখন সংশ্লিষ্ট দু’টি মন্ত্রণালয়কে একত্রে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে দেশে আটকে পড়া শ্রমিকদের কীভাবে কাজে ফিরানো যায় সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে ও পরে যেসব প্রবাসী দেশে ফিরছেন তারা এই মুহূর্তে কর্মহীন হয়ে আছেন। সরকার বিভিন্ন শর্তে ঋণ দেয়ার কথা বললেও, প্রবাসীদের এই ঋণ পেতে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এপ্রিলের পরে যারা ফেরত আসছেন তাদেরকে ৪% সুদে ও তার আগে যারা আসছেন তাদেরকে ৯% সুদে ঋণ দেয়ার কথা থাকলেও এখনো কেউ তা পেয়েছেন কিনা জানা নেই। এছাড়া এই ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়াও অনেক দীর্ঘ। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য ঋণ প্রক্রিয়াটা আরো সহজ করা উচিত। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানা যায়, বিদেশ প্রত্যাগত কর্মীদের পুনর্বাসনে ৭০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন এবং তাদেরকে পুনঃপ্রশিক্ষণের মাধ্যমে আবারো বিদেশে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে করোনার ৬ মাস অতিবাহিত হলেও এর কোনো পজেটিভ ফল এখনো মেলেনি।