বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে বলে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের বয়স পুর্নবিন্যাসের সময় এসেছে বলে মনে করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মন্ত্রী বলেন, চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়িয়ে ৩৫-৪০ করা এবং অবসরের বয়সও ৬৫ করা যেতে পারে। এটা নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি।

ডয়চে ভেলে : করোনার সময়ে দেশে বেকার সংখ্যা কেমন?
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান : আমরা জানতাম যারা দারিদ্রসীমার নিচে, অর্থাৎ কাজবিহীন তারা বেকার।  করোনার আগে এই সংখ্যা ছিলো ২০ শতাংশ। করোনার কারণে অনেক মানুষের কাজ নেই। শহরে যারা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করতেন, তারা কর্মহীন হয়ে গেছেন। সিপিডি ও পিআরআইসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হিসেবে এটা ৩৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। এখন তো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। ফলে এখন আর ৩৫ নেই, আবার ২০ ভাগেও আসেনি। আমার মনে হয়, এটা ২২ থেকে ২৫ শতাংশ হবে। এখনো কোন পরিসংখ্যান হয়নি। যেহেতু পরিসংখ্যান ব্যুরো আমার আওতায় আছে তাই খুব শিগগিরই আমরা একটা হিসাবের কাজে হাত দেবো।চাকরির বর্তমান বয়সসীমা যখন নির্ধারণ করা হয়েছিলো তখন তো গড় আয়ু কম ছিলো, এখন আয়ু বেড়েছে। বয়সসীমা নতুন করে নির্ধারণের কোন ভাবনা আছে কি-না? সরকারের কোনো ভাবনা আমি বলতে পারব না। আমার জানা মতে মন্ত্রিসভায় এমন কোনো কাগজ উপস্থাপিত হয়নি। বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, আমার জানা মতে সেটা সেই অবস্থাতেই আছে।

গড় আয়ুর সঙ্গে কর্মসংস্থানের সম্পর্কটা কেমন?
গড় আয়ু বাড়লে যেটা হয়, অবসরের পরও কাজ করার সামর্থ্য থাকে। আগে এক সময় অবসরের বয়স ছিলো ৫৬, এখন সেটা ৬০ করা হয়েছে। গড় আয়ু তখন ছিলো ৫৫-৫৬, এখন ৭২ বছর প্রায়। এই যে বাড়তি ১৫ বছর, মানুষ তো কিছু করে খেতে চায়। এখন কিন্তু মানুষের দৈহিক ক্ষমতাও বেড়েছে। এখন মানুষ ভালো খায় আগের তুলনায়। গড় আয়ু বাড়ায় আমাদের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। ফলে এটা আমাদের বেকারত্বের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। এটাও এক ধরনের বেকারত্ব। অবসরে যাওয়ার পরও এখন মানুষ কাজ খোঁজে। তারা কিন্তু অভিজ্ঞ, কাজ করে খেতে চায়। বর্তমান চিত্রটা কিন্তু এমনই।সেই হিসেবে চাকরিতে ঢোকার বয়স সীমা বাড়ানো উচিত কি-না? আমি আমার চিন্তার কথা বলতে পারি। কারণ সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে অর্থনৈতিক বিষয়, সামাজিক বিষয় চিন্তা করতে হয়। উন্নত দেশে আমাদের মতো ক্যাডার, বয়স বা নিয়মকানুন নেই। আমাদের এখানে ব্রিটিশরা যে মানষিকতা থেকে এটা করেছিল, এখন সেটা আর খাটে না। আমাদের বয়স বেড়েছে, স্বাধীনতা বেড়েছে, সক্ষমতা বেড়েছে, বিদ্যাবুদ্ধি বেড়েছে, সুতারাং এটার পুনর্বিন্যান প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। আমার ব্যক্তিগত মত, চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়িয়ে ৩৫-৪০ করা যেতে পারে। আবার অবসরের বয়সও ৬৫ করে একটা পুনর্বিন্যাসের সময় এসেছে। অনেক চাকরিতে কিন্তু এটা আছে। এটা নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি।

অনেক জায়গায় তো চাকরিতে ঢোকার বয়স নেই?
সেটাই বলছিলাম, পশ্চিমা যারা উন্নত তাদের ওখানে এটা নেই। আমরা এখনো ওই পর্যায়ে উন্নত হয়নি। কোন বাধা না থাকা সেটা হয়তো আমাদের জন্য একটু বেশি উদার হয়ে যাবে। তবে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ থেকে একটু বাড়ানো উচিৎ বলে আমি মনে করি। যদিও এটা সরকারের সিদ্ধান্তের ব্যাপার।

চাকরিতে ঢোকার বয়স সীমা বাড়ালেই কি কর্মসংস্থান বাড়বে?
চাকরিতে ঢোকার বয়স বাড়ালে প্রতিযোগিতাও বেড়ে যাবে। এখন কারো বয়স ৩০ পার হলে তিনি সরকারি চাকরি থেকে ছিটকে পড়েন। এখন বয়স বাড়ালে আরও বহু নতুন মুখ সরকারি চাকরিতে আবেদন করার সুযোগ পাবেন। এতে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে।

করোনার কারণে তো নিয়োগ বন্ধ ছিল। এখন কি নতুন করে ভাবনার সময় এসেছে কি-না?
পুরোপুরি বন্ধ ছিল না। কিছু কিছু নিয়োগ হয়েছে। নন ক্যাডার কিছু চাকরি হয়েছে। আমার মন্ত্রণালয়েও আগে যে নিয়োগগুলো পেন্ডিং ছিলো সেগুলোও প্রক্রিয়া করেছি। সামনে ধীরে ধীরে বাড়বে।

অবসরের সময় বাড়ালে নতুনদের চাকরি পেতে তো সমস্যা হবে। এক্ষেত্রে সমন্বয় হওয়া উচিৎ কি-না?
অবসরের বয়স বাড়ালে নিচের দিকে বয়স না বাড়ালে একটা অসম ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যাবে। আর যদি উপরের দিকে বাড়িয়ে নিচের দিকেও বাড়াই তাহলে একটা ব্যালেন্স হবে। তবে আবারও বলি, এটা বিশেষজ্ঞদর অনেক চিন্তাভাবনা করতে হবে। আমি বিশেষজ্ঞ নই, তবে এটুকু বুঝতে পারি নতুন একটা ক্ষেত্র তৈরী হবে। এতে প্রতিযোগিতা বাড়বে, চাপও বাড়বে সেটা মোকাবেলা করতে হবে আমাদের।

কর্মসংস্থান বাড়ানোর উপায় কী?
আমার হাতে কোন ম্যাজিক নেই। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ বলতে বড় বড় কোম্পানী বিনিয়োগ করবে তা নয়। গ্রামে একজন জামির মালিক, তিনি যদি পাঁচ বিঘা জমি বেশি চাষ করেন, বর্গা নিয়ে করলেও সে কিছু শ্রমিককে কাজ দিতে পারে। এইভাবে কর্মসংস্থান হয়। গ্রামে একটা ছেলে বেকার সে উদ্যোক্তা হয়ে মাছ বা সবজি চাষে নেমে যেতে পারে। এই সম্ভাবনা দেশে বেড়েছে এখন। আবার একটা মেয়ে কাঁথা সেলাই, চাদর সেলাইসহ এই ধরনের কাজ সৃষ্টি হচ্ছে আমাদের সমাজে। এগুলোও কাজ। আমরা মনে করি, সরকারি চাকরি, যার চেয়ার থাকবে, টাওয়েল থাকবে। নয়টা-পাঁচটা অফিস করে বাড়ি চলে যাব। এখন আর এই ধরনের মানসিকতার চাকরি সম্ভব হবে না। এখন চাকরি হবে কাজ ভিত্তিক। আমাকে নেবে, পয়সা দেবে, কাজ শেষে বাড়ি চলে যাব। চাকরি একটা বাজারের মতো।

সরকারী চাকরিতে নারী-পুরুষের বৈষম্য কেমন?
বৈষম্য তো ঐতিহাসিকভাবে ছিলো। নারী বলে নয়, তারা এমনিতেই সংখ্যায় কম আসতেন। তাদের ঘর থেকে বের হওয়ার একটা সাংস্কৃতিক বাধা ছিলো। কোন ধরনের কাজ, বাড়ি থেকে কতদূর গিয়ে কাজ করবে সেই ধরনের চিন্তা ছিলো। ছেলেদের সঙ্গে একই ঘরে বসে কাজ করবে এটার মানষিক বাধা বিপত্তি ছিলো। শিক্ষক, চিকিৎসা, নার্সিং ছাড়া অন্য পেশায় তারা আসতেন না। এখন নারীরা পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ সব ধরনের কাজেই আসছেন। তবে ঐতিহাসিক যে ঘাটতি ছিলো সেটা রাতারাতি পার হওয়ার নয়। শিক্ষা-চাকরিতে তারা এগিয়ে আসছে, কিন্তু বিশাল ফারাক রয়ে গেছে। দুশো- আড়াইশ’ বছরের ফারাক ক্লিয়ার করতে আরো ২০-২৫ বছর লাগবে। প্রতিবেশী দেশের তুলনায় আমরা দ্রুত গতিতে নারীদের কাজে আনছি। বর্তমান সরকারের যে পলিসি রয়েছে সেটা আরো কিছুদিন চললে এই বৈষম্য আমরা কমিয়ে আনতে পারব। সূত্রঃ ডয়চে ভেলে

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn