শহীদনূর আহমেদ : এ যেনো বাংলা সিনেমার গল্প,দীর্ঘ কয়েকযুগ ধরে চৌধুরী পরিবার আর খাঁ পরিবারে আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্ব। জলমহাল নিয়ে সেই দ্বন্দ্বের জেরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে প্রতিবছর ঘটে সংঘর্ষ আর নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনা। আর এসব সংঘর্ষে প্রাণ যায় গ্রামের নিরীহদের, লুটপাট হয় পুরো গ্রাম। তখন গ্রামছাড়া হয় শতাধিত পরিবার। বছর বছর ধরে স্থানীয় জলমহালকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এই গ্রামের এমন বর্বরতার কান্ডে গ্রামের সাধারণ পরিবারসহ আশপাশের গ্রামের লোকজনকে সবসময় আতঙ্কে থাকতে হয়। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া ইউনিয়নের মধুরাপুর গ্রামের দুই গোষ্ঠীর কথা। পুরো গ্রামটিই উপজেলাবাসির কাছে ভয়ঙ্কর এক নাম। এই গ্রামে সংঘর্ষ মানেই ভয়াবহ নৃশংসতা,হত্যা,লুটপাট,ভাঙচুর ঘটনা। গেলো ২৫ বছর ধরে গ্রামের চৌধুরী আর খাঁ গোষ্ঠীর মধ্যে আধিপত্য বিস্তার দ্বন্দ্বের জেরে ৪টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে একেকটি হত্যাকান্ডকে ঘিরে,বাড়িঘর ভাঙাচুর,লুটপাঠের ঘটনা ঘটে। হয় একাধিক মামলা। মামালা আর প্রাণের ভয়ে গ্রাম ছাড়া হয় অসংখ্য পরিবার।
সর্বশেষ গত ১৩ অক্টোবর দুপক্ষের সংঘর্ষে খান গোষ্ঠীর নূর মোহাম্মদ (৫০) নামে একজন খুন হন। আহত হন দুই পক্ষের অর্ধশত । সংঘর্ষের সময় ঘটে গ্রামে ভয়াবহ তান্ডব বাড়িঘর ভাঙ্চুর আর লুটপাটের ঘটনা। বাড়ি ঘরের এসব ছবি দেখলেই স্পষ্ট কি ধরনের ভয়াবহতা ঘটেছে। এ ঘটনায় দুই পক্ষের মধ্যে মামলা হয়েছে। হত্যা মামলায় চৌধুরী গোষ্ঠীর শতাধিক পরিবারের নারী পুরুষ ও শিশুরা গ্রামছাড়া। প্রতিপক্ষের হামলা আর গ্রেফতার এড়াতে ভয়ে ফিরতে পারছেননা বাড়িঘরে। দুই গোষ্ঠীর এমন দ্বন্দ্বে এলাকার শান্তিশৃংখলাসহ বিঘ্নিত হচ্ছে প্রাত্যহিক জীবন ব্যবস্থা। আর্থিক ক্ষতিসাধনসহ দেখা দিয়েছে মানবিক বিপর্যয়। এমতাবস্থায় দুই গোষ্ঠীর স্থায়ি দ্বন্দ্ব নিরসন ও গ্রামের সহবস্থান নিশ্চিতে পুলিশ প্রশাসনের
সরেজমিনে মধুরাপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, অনেক বসত ঘরে লোকশূণ্য। ঘরে দরজা-জালানালা আসবাবপত্র ভাঙ্গা। কোনো কোনো ঘরের চাল ও বেড়া খুলে নেয়া হয়েছে। দালাল ঘরে ছাদ, ইটের দেয়াল ভেঙ্গে কংক্রিটের স্থপে জমা রয়েছে। অনেক নলকূপের উপরিভাগ তুলে নিয়ে পানিদার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করাসহ নানাভাবে ক্ষতিসাধন করা হয়েছে শতাধিক ঘরবাড়ি। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানাযায়, দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া ইউনিয়নের মধুরাপুর গ্রামের আশের পাশের কয়েকটি হাওরের জলমহালের আয়ের টাকায় স্থানীয় মসজিদ, ঈদগাহ ও মাদ্রাসার উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করা হতো। ২৫ বছর জলমহালের টাকা নিয়ে গ্রামের চৌধুরী ও খাঁ গোষ্ঠীর নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। চৌধুরী পক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন দিলহক ও আমজদ চৌধুরী।খাঁ গোষ্ঠীর নেতৃত্বে তোফায়েল খাঁ,আব্দুল খালেক, নূর জালাল গং। ১৯৯৫ সালে তসলিমা নামে ৭ বছরের এক শিশু হত্যাকান্ড ঘটে। ২০০০ সালের পর লোকমান নামে এক জেলে হত্যা হয়। এই দুইজনই খান গোষ্ঠীর পক্ষের লোক। ২০০৬ সালে ঘটে মুক্তিযোদ্ধা আকিক মিয়া হত্যাকান্ড ঘটে। মুক্তিযোদ্ধা আকিক মিয়া চৌধুরী গোষ্ঠীর। বিগত ৩ হত্যাকান্ড নিয়ে দীর্ঘদিন মামলা চলার পর শালিসের মাধ্যমে আপোষ মিমাংশায় আসেন দুই পক্ষ। এসব ঘটনার নেপত্ম্যে চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছেন দুই গোষ্ঠী প্রবাসি ও প্রভাবশালীরা।
মামলা হামলার অর্থের সংস্থান দিচ্ছেন তারাই।ছাড়া সংঘর্ষ, ভাঙচুর ,লুটপাট, বসত ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়ার অভিযোগে এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে অন্তত ৩০টি মামলা হয়। যা কয়েকবছর আাগে স্থানীয় শালিসের মাধ্যমে আপোষ নিষ্পত্তি করা হয়। পুরনো দ্বন্দ্ব নতুন মোড়ক নেয় চলতি বছরের মে মাসের শেষের দিকে। ২২ মে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের আহাত হন অন্তত ৪০ জন। এ নিয়ে পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি মামলা হয় । সর্বশেষ ১৩ অক্টোর দুই পক্ষের মধ্যে সংর্ষের খুন হন নূর মোহাম্মদ নামে আরেক জন। হত্যার পর প্রতিপক্ষের হামলার ভয়ে চৌধুরী গোষ্ঠীর শতাধিক পরিবার ঘরবাড়ি ছাড়া রয়েছেন। তাদের অভিযোগ হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের লোকেরা তাদের কয়েকশ বাড়ি ভাঙচুর ও ব্যাপক লুটপাট করেছে। প্রতিপক্ষের ভয়ে বাড়ি ফিরতে পারছেননা তারা। এদিকে লুটপাট ভাঙচুর পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন খান গোষ্ঠীর লোকজনও। এভাবে দুই বংসের গেল ২৫ বছরের ৪ হত্যা আর অসংখ্য মামলা হামলা দুই গোষ্ঠীর দ্ব›েদ্বর স্থায়ি রূপ নিয়েছে। এরূপ অবস্থায় পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছেন দুপক্ষই।
চৌধুরী গোষ্ঠীর মো. মামুন চৌধুরী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে চৌধুরী ও খাঁ গোষ্ঠীর মধ্যে মামালা হামালা চলে আসছে। গেল ২৫ বছরে এশাধিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে। হত্যা মামলার প্রতিটির রায় আমাদের পক্ষে দিয়েছেন আদালত। গত ১৩ অক্টোবর সংর্ষে একজন নিহত হলেও এতে আমাদের লোকজন জড়িত নন। সংর্ষের পর প্রতিপক্ষের লোকেরা আমাদের ২ শতাধিক ঘরবাড়ি ভাঙ্গচুর ও ব্যাপক লুটপাট করেছে। হাজার মন ধান, ১৫০ টি গরু, শতাধিক ভেড়া, ঘরের মূল্যবান আসবাবপত্র ও স্বর্ণালঙ্কার লুট করে নিয়ে গেছে খান গোষ্ঠীর লোকেরা। এসময় তারা দুইটি ঘরে আগুন দেয়। তাদের ভয়ে আমাদের ৩ শতাধিক পরিবারের কয়েক হাজার মানুষ গ্রাম ছাড়া। আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামে তারা আশ্রয় নিয়েছে। খুব মানবেতন জীবনযাপন করছেন। তিনি বলেন , যতেষ্ঠ প্রমান থাকার পরও পুলিশ মামলা নিচ্ছে না। এক্ষেত্রে পুলিশ সুপারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
নূর জালাল (অপর পক্ষ) বলেন, আমরা নিরীহ মানুষ। ১৩ অক্টোবর নূর মোহাম্মদকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে চৌধুরী গোষ্ঠীর লোকেরা। এর আগে আমাদের অনেক বাড়ির ঘর ভাঙচুর করেছে তারা। সংঘর্ষে দিন কিছু ঘরবাড়ি ভাঙা হয়েছে। আমরা এই হত্যাকান্ডের ন্যায় বিচার চাই। দোষিদের আইনের আওতায় আনার দাবি করেন তিনি। ভাটিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান কাজি বলেন স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষদের নিয়েই বার বার এসব ঘটনায় সমাধান চেষ্টা করেছি আমরা। পূর্বপুরুষদের চলে আসা দ্ব›দ্ব আর বিচার না হওয়ায় এর সমাধান হচ্ছেনা। পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান দীর্ঘদিন গ্রামে আধিপত্য নিয়ে বার বার এমন ঘটনা ঘটে আসছে। এসব ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, হত্যা এবং বাড়ি ঘর ভাঙ্চুররের ঘটনা দুপক্ষের মামলাাই নেয়া হয়েছে। কিন্তু সামজিকভাবে এসব দ্বন্দ্বের সমাধান না হলে এসব বিরোধ বাড়বেই।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
৭৮ বার