সুজাত মনসুর-

সূর্যের দেশ ও আমার লেখা লেখি-:

জল-জোসনার দেশ, ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জ সকল সময়ই রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা, আত্মাধ্যিকতা অর্থাৎ সকল ক্ষেত্রেই গুণীমানুষের জন্ম দিয়েছে। বোরো ধান, মাছ উৎপাদন, খনিজ সম্পদ ও শিক্ষিত জনপদের নামও সুনামগঞ্জ। হাসনরাজা, দুরবিন শাহ, কালা শাহ, আরকুম শাহ, রাধারমণ, বাউল স¤্রাট আব্দুল করিম, মরমী শিল্পী শফিকুন্নুর, দার্শনিক দেওয়ান আজরফ এবং বঙ্গবন্ধু সরকার ও জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদের জন্য যেমন আমরা গর্ব করি, তেমনি আরো অনেকেই আছেন যারা আসলেই সুনামগঞ্জের সুনাম। সুনামগঞ্জের সুনামদের মধ্যে ভাষা সৈনিক মরহুম আব্দুল হাই অন্যতম। তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক গুণাবলীর অধিকারী। প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা ও মানবিক গুণের অধিকারী অনেকটা প্রচার বিমূখ ছিলেন বলেই হোক বা কখনওই সম্পদশালী কিংবা ক্ষমতাবান ছিলেন না বলেই হয়তো বর্তমান প্রজন্মের নিকট তাঁকে তুলে ধরার তেমন প্রয়াস চোখে পড়ে না। তবে ইদানিং তাঁর পরিবার-পরিজনদের পক্ষ থেকে সে প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। কথা আছে না আলোকিত সূর্য্য একদিন বিকশিত হবেই। তিনি আমার বাবার বন্ধু ছিলেন এবং পরবর্তীতে সেই বন্ধুত্বকে আত্মীয়তার বন্ধনে নিয়ে আসার জন্যই আমার বিচক্ষণ বাবা মরুহম আব্দুল হাই-য়ের বড়মেয়ে দীপা নাহার মুর্শেদার সাথে আবার বড়ভাই সিলেটের সিনিয়র সাংবাদিক আল আজাদের বিয়ে দেন। যদিও বাবার বন্ধু আব্দুল হাই সাহেব তখন বেঁচে নেই। বড়মেয়ের বিয়ের কয়েক বছর পর তাঁর সহধর্মিনী বিগত হয়েছেন। আমার বড়ভাবী পরলোক গমন করেছেন এক যুগেরও অধিক সময় ধরে। জীবিত আছেন তাঁদের মেয়ে ও নাতি-নাতনিরা।

ভাটির জনপদের অন্যতম আলোকিতজনের সাথে আমার পরিচয়ও হয় আমার বাবার বদৌলতে। দিরাই উপজেলা সদরে আমাদের বাড়ির পুর্বদিকের সীমানা সংলগ্ন পোষ্ট অফিস। ১৯৭২ সালের একদিন সকালবেলা ঘরের সামনে বসে আছি। হঠাৎ দেখি ডাক পিয়ন পোস্ট অফিস থেকে বের হয়ে আমাদের বাড়ির দিকে আসছেন। তেমন কোন আগ্রহ দেখাচ্ছি না। ভাবলাম আব্বার কোন চিঠি হতে পারে। কিন্তু না দেখি, তিনি আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার হাতে একটা পত্রিকা ধরিয়ে দিয়ে  চলে গেলেন। আমি তো অবাক। বান্ডিল খুলে দেখি পত্রিকার নাম ‘সুর্য়ের দেশ’, সাপ্তাহিক পত্রিকা। চিন্তা করতে লাগলাম কে আমার নামে পত্রিকাটি পাঠিয়েছেন? পত্রিকা নাড়াচাড়া করছি দেখে আব্বা ঘর থেকে বের হয়ে এসে বললেন, তিনি সুনামগঞ্জ যখন গিয়েছিলেন তখন আমাকে পত্রিকার গ্রাহক করে এসেছেন। ইচ্ছে করেই আগে বলেননি, পত্রিকা হাতে পেলে আমার প্রতিক্রিয়া কি হয় তা দেখার জন্য। পত্রিকাটির যিনি সম্পাদক তিনি আব্বার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, নাম আব্দুল হাই। আমাকে পত্রিকা পড়তে আগ্রহী করা ও দেশের খবরাখবর সম্পর্কে যাতে জানতে পারি সেজন্য নাকি তিনি পত্রিকা সাবস্ক্রাইব করে আসেন। আব্দুল হাই চাচা, বর্তমানে যিনি আমার বড় ভাইয়ের শ্বশুর, টাকা নিতে চাননি কিন্তু আব্বা জোর করে দিয়ে এসেছেন। আমার বাবা আমাকে এভাবেই তিলে তিলে রাজনীতি আর লেখালেখির জগতে এগিয়ে যেতে সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। সেই সত্তর সালেই তিনি আমার জন্য বানিয়ে দিযেছিলেন ‘মুজিব কোট’। উল্লেখ্য, এই সুর্যের দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রথম রিপোর্টের মাধ্যমেই আমার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। আর সত্তর সালে বঙ্গবন্ধুর জনসভার প্রচার চালাতে চালাতে রাজনীতিতে হাতেখড়ি। সত্যিকারের আলোকিতজনেরা অন্যকেও আলোর পথ দেখান। আমার বাবাও তেমনি একজন আলোকিত মানুষ ছিলেন। তাই তিনি আমাকে আরেকজন আলোকিত মানুষের পরিচয়ের সূত্র ধরিয়ে দিয়েছিলেন। যিনি স্বাধীনতা উত্তর সুনামগঞ্জের মানুষকে আলোর পথ দেখাতে জ্বেলেছিলেন এক প্রদীপ শিখা, যার নাম ছিল সূর্য্যরে দেশ। মরহুম আব্দুল হাই শুধু পত্রিকার মাধ্যমেই আমার মত কিশোর-তরুন-যুবকদের আলোর দিশা দেননি, তিনি শিক্ষকতা ও একজন লেখক হিসেবে শত শত ছাত্র ও পাঠককে আলোর দিশা দিয়েছেন।

স্বাধীনতার পরপরই সুনামগঞ্জ থেকে দু’টি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হয়। একটির নাম ‘বিন্দু বিন্দু রক্তে’, সম্পাদক এক সময়ের ন্যাপ নেতা ও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির সহসভাপতি মরহুম গোলাম রব্বানী। আরেকটির নাম সূর্যের দেশ’ সম্পাদক মরহুম আব্দুল হাই। রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, লেখক ও শিক্ষাবিদ আব্দুল হাই ছিলেন বর্নাঢ্য জীবনের অধিকারী। তিনি একাধারে যেমন ছিলেন মেধাবী ছাত্র, তেমনি আদর্শ শিক্ষক। নীতি-নৈতিকতার মানদন্ডে ছিলেন শতভাগ শুদ্ধ মানুষ। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি পর্বে ছিল তাঁর গৌরবময় ভূমিকা। ১৯৫১ সালে ছাত্র ইউনিয়ন গঠিত হলে তিনি বৃহত্তর সিলেট ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে ছিলেন সুনামগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাচ্যুত হবার পর তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। সুনামগঞ্জ এইচএমপি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনের মধ্যদিয়েই সমাপ্তি টানেন পেশাগত জীবনের। সুনামগঞ্জবাসী এখনো তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।

তিনি অকালপ্রয়াত একজন ক্ষণজন্মা মানুষ। জীবনে চাইলে ধন সম্পদসহ অনেক প্রতিপত্তির মালিক হতে পারতেন। তাঁর সমসাময়িক অনেকেই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে ও নীতি-নৈতিকতা বিসর্জণ দিয়ে দুনিয়াতে অঢেল ধন সম্পদের মালিক হয়েছেন। এমপি মন্ত্রী হযেছেন। কিন্তু মরহুম আব্দুল হাই নিজেকে অর্থ-সম্পদের কাছে বিকিয়ে দেননি। নিজের নীতি-নৈতিকতা জলাঞ্জলি দিয়ে স্ত্রী সন্তানদের টাকা-পয়সা ধন দৌলতের উত্তরাধিকার করে যাননি। তিনি ছিলেন আজীবন সংগ্রামী মানুষ। নির্বাচন করতে গিয়ে সতীর্থ-সমর্থকরা পেছনে ছুড়ি মেরেছে, বেঈমানী করেছে, কিন্তু তিনি নতিস্বীকার করেননি। একাই লড়াই করে হেরে গিয়ে জিতে গিয়েছেন। জীবনে আপোষ বলে কোন শব্দ তাঁর অভিধানে ছিল না।

তিনি ধন-সম্পদ কিংবা অট্টালিকা সন্তানদের জন্য রেখে যেতে না পারলেও, নীতি-নৈতিকতা, সততা, আদর্শের যে ভান্ডার রেখে গিয়েছেন কোনদিনও ফুরিয়ে যাবে না। তিনি যেমন লড়াই করে বেঁচে ছিলেন। আপোষ কোন শব্দ তাঁর অভিধানে ছিল না, তেমনি তাঁর তিন সন্তানও আপোষ না করে, কারো নিকট মাথানত না করে, বাবার রেখে যাওয়া নীতি-নৈতিকতা, সততা, নিষ্ঠা ও লড়াকু মনোভাব নিয়ে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁদের সন্তানদেরও নানার আদর্শে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। তাঁদের জন্য শুভ কামনা নিরন্তর। আলোকিতজনেরা আমাদের আলোর দিশারী হয়েই থাকুন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে
লেখকঃ-লেখক, সাংবাদিক। যুক্তরাজ্য প্রবাসী।
৭ই নভেম্বর, ২০২০
হোয়াইহ্যাভেন, ইউকে

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn