রবিউল লেইস রোকেশ–মানুষ প্রতিভা নিয়ে জন্মায়, না-কি যথাযথ পরিচর্যায় প্রতিভা বিকশিত হয়, বিষয়টি বরাবরই  দ্বান্দ্বিক। যদি পরিচর্যায় প্রতিভা বিকশিত হয়, তাহলে একই প্রতিষ্ঠান থেকে একই পর্যায়ের শিক্ষা গ্রহণের পর সকল শিক্ষার্থীর উন্মেষ কী সমান হয় ? আবার একই মা-বাবা’র সন্তান একই পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেও আচার আচরণে স্পষ্টতই যোজন যোজন তফাৎ পরিস্ফুট হওয়ার বিষয়টিও, রয়েই যায়।

শিক্ষা মানুষকে ‘মানুষ’ করে তোলে। শিক্ষা’ বলতে সাধারণ অর্থে প্রকাশ পায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। তবে, প্রকৃত অর্থে শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিকতার গন্ডিতে আবদ্ধ, না-কি প্রকৃতির অসীমতায় ব্যাপ্ত, এ বিতর্কও চিরকালীন। এতো সকল দ্বন্দ্ব, তর্ক বিতর্ক যুগযুগ থেকে অনিষ্পন্ন থাকলেও, সাধারণে থেকেও কেউ কেউ আপন আলোয় হয়ে উঠেন আলোকিত।

যাঁরা নিজেদের কর্মের, কীর্তির চিহ্ন এঁকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যান, অনুকরণীয় পথের দিশা। নিজেকে অতি সাধারণ থেকে কর্মময়তায় করে তুলেন অনন্যসাধারণ।  এম-নি এক কীর্তিকর, সুনামগঞ্জের আদি বসতি আরপিন নগরের আব্দুল হাই গোলাপ মিয়া। যাঁর জীবন যাপন বাহ্যিক বেশভূষা চলনবলন ছিলো আটপৌরে ; তবুও তিনি তাঁর কর্মে, জ্ঞান চর্চায়, সাধনায়, মানব সেবায় হয়ে উঠেছিলেন মানবিক মানুষ।

আমার সৌভাগ্য হয় খুবই ছোট বেলাতেই পাশাপাশি বাড়িতে বসবাসের সূত্রে তাঁকে দেখার। তখন শুধুই দেখেছি, শৈশবের স্মৃতিতে একটি দুটি আবছায়া ছবি এখনো অনেকটাই দৃশ্যমান। আমরা ১৯৬০ সনে বাড়ি থেকে হাছননগরস্থ বাসায় চলে আসলেও প্রায়শ বাড়িতে যাওয়া আসায় উনাকে দেখেছি, যে দেখায় উল্লেখ করার মতো কিছু নেই।

ছোট বেলাতেই আব্বা’র (ড.আবুল লেইছ) কাছে মনীষীদের গল্প যেমন শুনতাম, পাশাপাশি সুনামগঞ্জের আলোকিত মানুষদের কাছে নিয়ে যেতেন আলাপ করিয়ে দিতেন। সম্ভবত ৬৩’ সন আব্বা সাথে করে নিয়ে গেলেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে, এখন যে স্থাপনার অস্তিত্ব নেই তখন যা ছিলো যোগপোযোগী আধুনিক, বর্তমান ট্রাফিক পয়েন্টের উত্তর মুখী রাস্তার পূর্ব পাশে উত্তরদক্ষিণে লম্বালম্বি কাঠের তৈরী গৃহ যা সুনামগঞ্জের প্রথম কলেজ ভবন, পরবর্তীতে পুরাতন কলেজ পরিচয়ে আরো প্রায় দু’দশক টিকে ছিলো। সেই ভবনের দক্ষিণের ঘরটি যতোটুকু মনে আছে যথেষ্টই বড় ছিলো। দক্ষিণ পাশের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢোকার সময় সম্ভবত দু’জন ছিলেন তার মধ্যে একজনের সাথে আব্বা কথা বললেন, আমাকে চিনিয়ে দিলেন আমাদের পাশের বাড়ির গোলাপ মিয়া। উনি আমাকে কাছে নিয়ে কথা বলেছিলেন, আমাদের ভিতরে নিয়ে সাদা চাঁদর পাতা মেঝেতে বসতে দিলেন। ঘরটিতে বিশ পঁচিশজন মতো লোক ছিলেন, উত্তরের অংশে একটু উচু মতো করে স্টেজ ছিলো, যেখানে বসে তখনকার সময়ের কুচি দেয়া ফোলানো মতো ফ্রক পড়া ১২/১৩ বছরের একটি মেয়ে গান করেছিলো। শিল্পি কে ছিলেন মনে নেই আর

অনুষ্ঠানের অন্য অংশতে কী কী হয়েছিলো তাও মনে নেই। তবে যতোটুকু মনে পড়ছে গানটির প্রথম লাইনটি ছিলো “ভূত আমার পুত পেতনি আমার ঝি রাম লক্ষণ বুকে আছে ভয়টা আবার কী” এ গানটি আর কখনো শুনিনি।

বাসায় ফিরে আব্বা শিল্পির নাম পরিচয় বলেছিলেন, ভুলে গেছি। তবে মনে আছে বলেছিলেন গোলাপ মিয়া উনার তিন ক্লাশ জুনিয়র এবং উনাদের সমসাময়িক কালের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। ব্রিটিশ ভারতে ১৮৭৪ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত সিলেটকে বাংলা থেকে কেটে নিয়ে আসাম প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়। গোলাপ মিয়া তৎকালীন সমগ্র আসাম প্রদেশে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। আরো বলেছিলেন ৪৮’ সনে জুবিলী তথা সুনামগঞ্জ থেকে মেট্রিক পাশ করাদের অন্যতম ছিলেন গোলাপ মিয়া, কথাগুলো মনে গেঁথে আছে।

সুনামগঞ্জের অনেক শুরুর শুরুতে থাকা আব্দুল হাই গোলাপ মিয়ার কাছে যাওয়ার, সাহচর্য পাওয়ার সুযোগ থাকলেও যাওয়া হয়নি, বুঝতে পারিনি বলে। এখন মনে হয় উনার কাছ থেকে অনেক অনেক কিছুই জানার, শিখার সুযোগ হারিয়েছি। অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হয়েও কতো সহজ সারল্যে কর্মী হয়ে উঠার এক বিরল গুণাবলী ধারণ করতেন।

অধুনা ‘শিল্পকলা একাডেমী’ তদানীন্তন ‘আর্টস কাউন্সিল’

সুনামগঞ্জ ; গড়ে তোলার অগ্রণীদের অন্যতম ছিলেন গোলাপ মিয়া এবং দীর্ঘদিন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থেকে শিল্প সংস্কৃতি’র সূতিকাগার হিসাবে প্রতিষ্ঠানটিকে দাঁড় করাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। সুনামগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার অগ্রসৈনিকদেরও তিনি অন্যতম।

ষাটের দশকে তখনকার আবহে সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট উৎসব আয়োজনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন আব্দুল হাই গোলাপ মিয়া। উনার উদ্যোগে ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে আয়োজিত হতো হাছন মেলা, কৃষি মেলা, (সাধারণে এই নামে পরিচিত হওয়ায় পোষাকী নাম চাপা পড়ে যেতো)  গ্রামীণ ও শহুরে সংস্কৃতির সংমিশ্রণে তখনকার সময়ের শালীন বিনোদন ও শিক্ষা পসারে ঐসকল আয়োজন ভূমিকা রাখতো।

সমাজ সংস্কারে জড়িত থেকে ঐসময়ের সামাজিক আন্দোলনে যেমন ছিলেন অগ্রণী, তেমনি রাজনৈতিক চিন্তা চেতনায় শুধু ঋদ্ধই ছিলেন না, একজন সাধারণ কর্মী থেকে নেতৃত্বের গুরু দায়িত্বও পালন করেছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধিকার, স্বাধীনতা প্রতিটি আন্দোলন, সংগ্রামে ওতপ্রতো জড়িয়ে থেকেছেন, ভূমিকা রেখেছেন।

নাট্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। পর্দার পিছনে সামনে সমান দক্ষতায় নিজের উৎকৃষ্টতার ছাপ রেখে গেছেন। অতি সম্প্রতি নির্ভরযোগ্য প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে শোনা, উনি ক্রিকেটও খেলেছেন। উনাদের সময়ে প্রকাশনা অত্যন্ত ঝক্কিপূর্ণ হলেও উনি প্রকাশনা শিল্পের সাথেও জড়িয়ে ছিলেন। নিজ সম্পাদনায় ‘দেশের দাবী’ ‘সুরমা’ ‘সূর্যের দেশ’ পত্রিকা সমূহ প্রকাশ করতেন। নিজে সাংবাদিকতাই শুধু করেননি হাতে কলমে সাংবাদিক সৃষ্টিতে গড়েছেন অনন্য নজির, তিনি সুনামগঞ্জে আধুনিক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ।

আব্দুল হাই গোলাপ মিয়া হাছন রেজা’র লেখা সংগ্রহ করে পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন। হাছন রেজা কে নিয়ে গবেষণা করেছেন। নিজেকে ‘হাছন পছন্দ’ পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। তিনি নিজেও কাব্য

রচনা করেছেন, তাঁর লেখাগুলো সংগৃহীত ও প্রকাশিত হওয়া, সাধারণে উপস্থাপিত হওয়া জরুরী। আব্দুল হাই সাহেব সুনামগঞ্জ কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষকতাও করেছেন।

আব্বার কাছে সেই শৈশবে শোনার পর থেকে উনাকে যখনই দেখেছি অত্যন্ত বিস্ময় নিয়ে দেখতাম। শিক্ষকতা করতেন বিধায় সাহস করে কাছে যাওয়া হয়নি। উনাকে দেখলে ক্যামন যেনো গম্ভীর রাশভারী বলেই মনে হতো।

ষাটের দশকে জুবিলী স্কুলে যাওয়ার পথে মাঝেমধ্যে উনাকে দেখতাম ঘাড় পর্যন্ত লম্বা ব্যাকব্রাশ করা চুল সাইকেল চড়ে এইচএমপি স্কুলে আসতেন, আবার এইচএমপি’র বারান্দায় হাঁটা চলাতেও দেখেছি, পাজামা পাঞ্জাবি পড়ে অতি সাদাসিধা চলাচলেও একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব কতোটা ফোটে উঠে উনাকে না দেখলে তা উপলব্ধি করা যায় না।

সুনামগঞ্জ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ক’বন্ধু মিলে বালাট যাই, ওখানে একরাত ছিলাম। সুনামগঞ্জের নেতৃস্থানীয়দের অনেককেই বালাটে শুক্কুর মিয়ার বাড়িতে দেখি। ঐ বাড়িতে প্লাঙ্কিং করা ঘরের কাঠের মেঝেতে রাতে আমাদের শোয়ার ব্যবস্তা হয়, একই কক্ষে থাকা খাটে আব্দুল হাই সাহেব উনার ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে শুয়েছিলেন।

আব্দুল হাই সাহেবের সাহচর্য পেয়েছেন উনার সাথে কাজ করেছেন প্রবীণ আইনজীবি যিনি সাংবাদিকতার সাথেও ওতপ্রোত জড়িয়ে ছিলেন আছেন। আব্দুল হাই সাহেবকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে অনেকটা আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘আব্দুল হাই সাহেব কর্ম উদ্দীপনা, মেধা, বিচক্ষণতা বিবেচনায় আমাদের জন্য অনেক সৃষ্টি রেখেগেছেন। বহুমাত্রিক পতিভা তার ছিলো। অনেক বিষয়ে নজর না দিয়ে বা নিজেকে জড়িত না রেখে তিনি যদি তার মেধা ও শ্রম এক  বিষয় ব্যয় করতেন, তাহলে  জাতীয় ভাবে সুখ্যাতি লাভ করতেন নির্দ্ধায় তা বলা যায়।’

আব্দুল হাই সাহেবের মতো বিরল ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে  যতো বেশী চর্চা হবে জানা যাবে জানানো যাবে ততোই সমৃদ্ধ হবে সুনামগঞ্জের আগামী। উনার শ্রম, ঘাম, মেধায় গড়ে উঠা আধুনিকতার ছোঁয়া পাওয়া শিল্পকলা, পাবলিক লাইব্রেরী উদ্যোগী হয়ে আব্দুল হাই সাহেবের কর্ম, সৃজনশীলতা নিয়ে গবেষণা করবে এমনটাই আশা।

লেখক পরিচিতি-রবিউল লেইস রোকেস সিনিয়র আইনজীবি, সাবেক সভাপতি (সু,জে,আ,স) কবি ও লেখক।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn