ফয়সল আহমদ রুহেল::  শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু। ১২৫ টাকা বেতনে চাকরি। তাও আবার মাসের পর মাস আটকে থাকতো। শিক্ষকতা পেশাকে কেবলমাত্র অর্থ উপার্জনের মাধ্যম নয়, মহান ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। তা আন্তরিকতার সঙ্গে অনেকটা নিঃস্বার্থভাবে বিলিয়ে দেন শিক্ষার্থীদের মাঝে। শিক্ষকতা থেকে অবসরের পর morning শেষ জীবনটা কাটাতে চেয়েছিলেন এলাকায়। কখনো নির্বাচন করবেন, এমনটা ভাবেননি। উপজেলা পরিষদের নির্বাচন করেন। চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন। কিন্তু যে আকাঙ্খা নিয়ে জনপ্রতিনিধি হন সেই আকাঙ্খা পূরণ করতে পারেননি। শিক্ষকতার সুপ্ত বাসনা এখনো হৃদয়ে ধারণ করেন তিনি। বলছি সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় জন্ম নেয়া গুণী শিক্ষক মো. তফাজ্জল হোসেন (খোকন মাষ্টার) এর কথা।

জন্ম : মো. তফাজ্জল হোসেন ১৯৫৩ ইং সনের ৯ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের তরঙ্গীয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মৃত ওয়াজি উল্লাহ্, মাতা সাফিয়া বেগম। বাবা ছিলেন একজন কৃষক এবং মাতা ছিলেন একজন গৃহিনী। তফাজ্জল হোসেনের ৫ ভাই, ৩ বোন ছিলেন। এখন বর্তমানে জীবিত আছেন ৩ ভাই, এক বোন।

শিক্ষা জীবন : তফাজ্জল স্যারের শিক্ষা-জীবন শুরু ১৯৫৮ সালে তরঙ্গীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন মামার বাড়ি লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ উচ্চ বিদ্যলের থেকে। ১৯৬৮ সালে মানবিক বিভাগ থেকে, কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি পাশ করেন। তিনি ১৯৭০ সালে রামগঞ্জ কলেজ থেকে, ব্যবসা শিক্ষা শাখা হতে এইচএসসি পাশ করেন। পরবর্তীতে বিকম ডিগ্রী অর্জন করেন মদন মহন কলেজ থেকে ১৯৭৩ সালে। শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ বিএড ডিগ্রী- অর্জন করেন কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে।

শিক্ষকতা জীবন: তফাজ্জল হোসেন ১৯৭২ সালে সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের কাটাখালী পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসাবে যোগদানের মাধ্যমে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি উক্ত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পান ১৯৮০ সালে। এরপর ১৯৮৭ সালের পহেলা নভেম্বর প্রধান শিক্ষক হিসাবে বিশ্বম্ভরপুর সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে নিয়োগ পান এবং সুনামের সাথে উক্ত পেশায় নিজের সুদক্ষতার পরিচয় প্রদান করেন। পরবর্তীতে তিনি ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহনের উদ্দেশ্যে শিক্ষকতা পেশা থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।

শিক্ষক থেকে জনপ্রতিনিধি যেভাবে : শিক্ষকতা থেকে অবসরের পর এলাকায় শেষ জীবনটা কাটাতে চেয়েছিলেন। এলাকার উপজেলা নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের যোগ্য প্রার্থীর অভাব দেখা দেয়। তিনি পারিবারিকভাবে ছিলেন আওয়ামী লীগ ঘরনীর। সে নির্বাচনের আগে প্রস্তাব পান উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার। একবারেই সেই প্রস্তাবে না বলে দেন। কিন্তু নাছোড়বান্দা। তাঁকে নির্বাচনে দাঁড় করাবেই করাবে। এ নিয়ে অনেক দেনদরবার, পীড়াপীড়ি চলে। শেষ পর্যন্ত রাজি না হয়ে উপায় ছিল না তাঁর। তখন শিক্ষকতা জীবনের অবসরে যাওয়ার সময় বাকী ছিল মাত্র ৩ বছর। এর আগেই স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। তফাজ্জল হোসেনের কাছে তখন নগদ মাত্র ২৫ হাজার টাকা ছিল। মনোনয়নপত্র জমা দেন। ২০০৯ সালের ২২ জানুযারী অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যানও হয়ে যান তিনি। তিনি বলেন, মানুষ আমাকে বিশ্বাস করেছে, ভোটের বাক্সে নীরবে সেই আস্থার প্রমাণ পেয়েছি। কিন্তু চেয়ারম্যান হওয়ার পর বিভিন্ন জটিলতার কারণে এলাকার তেমন উন্নয়ন করতে পারেননি। এমনকি অর্থের অভাবে রীতিমত তাঁর সম্মানী দিতে পারতো না পরিষদ। এলাকার উন্নয়ন না করার বিষয়টি তাঁকে এখনও পীড়া দেয়। এই শিক্ষক উপলব্ধি করেন শিক্ষাজ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার মতো আনন্দ আর কিছুতে নেই।

শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি থানা পুলিশ কমিটি, স্কাউটের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজও চালিয়ে যান। শুধু পড়ানোর ক্ষেত্রে নয়, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতিতেও নিরলস কাজ করেন। তাঁর আমলে ১৯৮৯ ইং সনে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় এসএসসি পরীক্ষার সেন্টার নিয়ে আসেন। আগে এই উপজেলার শিক্ষার্থীরা সুনামগঞ্জ সদর ও জামালগঞ্জ গিয়ে পরীক্ষা দিতেন। এছাড়া তার বিদ্যালয়ে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার করা হয়।

পারিবারিক : শ্রদ্ধেয় মো. তফাজ্জল হোসেন ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। বড় ছেলে জাহাঙ্গীর কবীর রোকন-ব্যবসায়ী, ২য় ছেলে আলমগীর কবির রবিন-ব্যবসায়ী, ৩য় ছেলে হুমায়ন কবীর বাবলু (আমেরিকা প্রবাসী), ৪র্থ ছেলে এমরান কবীর লিটন (সিও, উপজেলা পরিষদ) ও ৫ম ছেলে জহিরুল কবির রায়হান। ১ম মেয়ে তানিয়া আক্তার, সহকারি কাসশনার (ভূমি) বিয়ানীবাজার উপজেলা, সিলেট। ২য় মেয়ে মুনিয়া আক্তার ফাস্টার্স অধ্যায়নরত, গ.ঈ কলেজ, সিলেট। ২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত গুণী শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি,আলী স্যার ফাউন্ডেশন সুনামগঞ্জ জেলার প্রত্যেক উপজেলায় অবসরপ্রাপ্ত দুইজন আদর্শ শিক্ষককে সম্মাননা পদকে মনোনয়নে জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ^ম্ভরপুর উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি।

সুনামগঞ্জ জেলার ১১ উপজেলার ২২ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)।

উল্লেখ্য, ২২ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জনকে আর্থিক সহযোগিতা এবং জেলার আদর্শ শিক্ষকের স্বীকৃতি হিসেবে ৫ জন শিক্ষককে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকে ভুষিত করবে সংস্থাটি।

শ্রদ্ধেয় মো. তফাজ্জল হোসেন (খোকন মাষ্টার) কর্মজীবনে বেশিরভাগই শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পড়ান। রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের খোঁজ খবর নিতেন। তিনি শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নিজ সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই উৎসাহ দেন নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে। দেন নীতিগত শিক্ষা। কখনোই সন্তানকে অন্যায় করতে উৎসাহ দেননি। যার ফলে নিজ সন্তানদের গড়েছেন সুশিক্ষায় শিক্ষিত। যারা আজ গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দেশের সেবা করছেন। এই শিক্ষকের ৩৬ বছরের কর্মজীবনের মাঝে নীতি ও আদর্শ খোঁজে পায় অসংখ্য শিক্ষার্থীরা। তাঁকে অনুসরণ করে তারা জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। তারই হাতে গড়া ছাত্ররা আজ সরকারের বিভিন্ন উচ্চ পদে আসীন। মানুষ জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে একা বোধ করেন। শেষ জীবনে তফাজ্জল হোসেন নিজ বাড়িতে বসবাস করছেন। আমরা এই শিক্ষকের নেক হায়াত কামনা করি।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn