আতিক রহমান পূর্ণিয়া, সুনামগঞ্জ থেকে-

হাওরাঞ্চলের দুর্ভোগ বিবেচনায় নিয়ে সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশনা দিয়েছে যে উপদ্রুত অঞ্চলে আপাতত ঋণের টাকা আদায় করা হবে না। সরকারি এ নির্দেশনা সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে বেসরকারি ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কার্যক্রম কেমন হবে সে বিষয়ে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। এমন পরিস্থিতিতে দুশ্চিন্তায় সময় পার করছেন ঋণগ্রস্তরা। এদিকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা তাদের বক্তৃতাকালে জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন তারা যেন এই মুহূর্তে এক বছরের জন্য ঋণ পরিশোধ না করেন। সেই সাথে এনজিওগুলোকে ঋণ উত্তোলনের জন্য সাধারণ মানুষকে চাপ না দিতে আহ্বান জানিয়েছেন।

বিশেষ করে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের ঋণ উত্তলনের বিপক্ষে এই অবস্থানকে সাধারণ মানুষ স্বাগত জানালেও ভালোভাবে নিচ্ছে না এনজিওগুলো। মাঠকর্মীরা এখনও ঋণ উত্তোলনের জন্য গ্রামে গ্রামে প্রতিদিন কাজ করছে। অপরদিকে এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো সরকারি বা এনজিওগুলোর নির্দেশনা না থাকায় ঋণগ্রস্ত মানুষ রয়েছে দ্বিধাদ্বন্দ্বে। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জের দুর্গত এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

বুধবার বিকালে সুনামগঞ্জের জামালপুর উপজেলার মাহমুদনগর গ্রামে কথা হয় গৃহবধু মাজেদা বেগমের সাথে। ছেলেকে সাথে নিয়ে গ্রামের খোলা জায়গায় হাওর থেকে কুড়ানো পচা খড়কুটো শুকাচ্ছিলেন। দু’সপ্তাহ আগে অকাল বন্যায় ফসল হারিয়ে মাজেদার পরিবার এখন দিশেহারা। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আশা থেকে ১৮ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। প্রতি সপ্তাহে তাকে ৫০০ টাকা করে দিয়ে তা পরিশোধ করতে হয়। কিস্তির টাকা গত দুই সপ্তাহ পরিশোধ করেনি।

মাজেদা বলেন, সাত সন্তানসহ তার নয় জনের সংসার। পেটে ভাত জোটে না। কিস্তি পরিশোধের চিন্তা করব কীভাবে। তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, শুনেছি কিস্তি পরিশোধ না করতে পারলে এনজিওগুলো মামলা করবে, জেলে দেবে। একই অবস্থা সুনামগঞ্জের ধরমপাশা রাজাপুর গ্রামের কৃষক মজু মিয়ার। তিনিও একটি এনজিও থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, এনজিওকর্মীরা কিস্তির টাকা নিতে আসে কিন্তু বুঝিয়ে বললে ফিরে যায়। একই উপজেলার জয়শ্রী বাজারে কথা হয় জয়শ্রী ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতি মাধক চন্দ্র সরকার এবং আওয়ামী লীগ নেতা নুরুজ্জামান, আব্দুল কাউয়ুম ও আবু লেইসের সঙ্গে। তারা বলেন, হাওরের মানুষের ঘরে খাবার নেই। গোয়ালের গরু সব বিক্রি হয়ে গেছে। হাওরে মাছ নেই। অনেক মানুষ হাওর ছেড়ে কাজের খোঁজে শহরে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় এনজিও ঋণ আপাতত পরিশোধ না করার জন্য আমরা জনগণকে বলেছি।

একই দাবি রাজাপুর গ্রামরে যুবলীগ নেতা বখতিয়ার, জোবায়ের ও আবুল খায়েরের। বুধবার রাজাপুর বাজারে পরিবর্তন ডটকমের প্রতিনিধিকে পেয়ে তারা বলেন, আমরা চাই সরকার এনজিওদের ঋণ নিয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিক।

জয়শ্রী বাজারে দেখা মেলে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সাথে। এই ব্যাংকের ম্যানেজার মিজানুর রহমানসহ অন্যান্য মাঠকর্মীরা জানান, কোনো কোনো এনজিও হাওরের এই দুর্ভোগের সময় ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু আগের ঋণের কিস্তি তুলছে ঠিকই। তবে গ্রামীণ ব্যাংক ঋণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছে এবং ঋণ আদায়ে কোনো চাপ দিচ্ছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামীণ ব্যাংকের এক কর্মী বলেন, মূলত হাওরের যেসব মানুষ আরো বেশি পরিমান ঋণ নিতে চাই তারাই কেবল পুরানো ঋণ কিস্তিতে পরিশোধ করছে। একই অবস্থা হাওরের অন্যান্য উপজেলাগুলোতেও। জনপ্রতিনিধিরা প্রকাশ্যেই এনজিও ঋণ পরিশোধ না করার ঘোষণা দিয়েছেন।

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়রম্যান কামরুজ্জামান বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে জনসভা করে আগামী এক বছর এনজিও ঋণ পরিশোধ না করার আহ্বান জানাচ্ছেন। জনগণকে আগে তাদের টিকে থাকার পথ করে নিতে পরামর্শ দিচ্ছেন। কামরুল পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, এনজিওর মাঠকর্মীদের এখন ঋণ তুলতে গ্রামে গ্রামে যাওয়া উচিত নয়।

নেত্রকোনা সদরের সংসদ সদস্য ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আরিফ খান জয়ও বিভিন্ন উপজেলায় সভা করে আপাতত এনজিও ঋণ পরিশোধ না করার ঘোষণা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ সম্প্রতি হাওরাঞ্চল ঘুরে এনজিওর ঋণ পরিশোধ না করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। টেলিফোনে যোগাযোগ করলে মাহবুব-উল আলম হানিফ পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, মানবিক কারণেই হাওরা অঞ্চলের এনজিও ঋণ আগামী ফসল না ওঠা পর্যন্ত উত্তোলন না করার কথা বলেছি। মানুষের দুর্ভোগ বিবেচনা করে এনজিওগুলোর একথা শোনা উচিৎ। এরপরও যদি এনজিওগুলো কথা না শোনে তাহলে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণ উত্তোলন বন্ধের বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে।

প্রসঙ্গত, হাওরে স্মরণকালের ভয়াবহ দূর্যোগের পর সরকারের পক্ষ থেকে আপাতত কৃষি ঋণ উত্তোলন স্থগিত করা হয়েছে। অসময়ের ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ফসল নষ্ট হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হাওরাঞ্চলের কৃষকদের কাছ থেকে কৃষি ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত রাখতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপন জারি করে সব তফসিলি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তাদের এ নির্দেশ দিয়েছে। ‘পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কাছ থেকে কৃষি ঋণ আদায় স্থগিত করার পাশাপাশি সহজ কিস্তি আদায়ের মাধ্যমে ঋণ নিয়মিতকরণ বা ডাউন পেমেন্টের শর্ত শিথিল করে ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ’ করতে বলা হয়েছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn