বাবা’র কাছে চিঠি লিখতে ইচ্ছে হয়–
ফাতেমা চৌধুরী স্বপ্না(ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে)-
আজকের দিন। আমার খুব বেশী মন খারাপ করে দেয়া একটা বিশেষ দিন। আজ আমার বাবা মরহুম আব্দুজ জহুর সাহেবের ৮ম মৃতূ্যদিবস। আজ থেকে আট বছর আগে ২২ই মে ২০০৭, বাবা আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন। বাবা নেই। দেখতে দেখতে আট বছর হয়ে গেলো। কতো কথা আজ মনে পড়ছে! ইচ্ছা করছে আমার মনের কথাগুলো সবার সংগে শেয়ার করি কিন্তু পারছি না। খুব যে কম কথা বলি, তা কিন্তু নয়। তবে কখনো কখনো একদম কথা বলতে ভালো লাগে না। চাইলেও তখন ভিতর থেকে কথা বের হয় না। চুপচাপ আর একা থাকতেই ভালো লাগে। আজকের দিনটা ও এমনি এক দিন। মনে কষ্ট থাকলে মানুষ কথা বলতে গিয়ে কখনো কাঁদে, বই পড়তে গিয়ে কাহিনীর কষ্টে চোখ ভাসায় কিন্তু কিছু লিখতে গিয়ে যে এতো কান্না পায় তা আমার এমন করে জানা ছিলো না। অনেক পুর্বে যখন দেশের সংগে আমাদের প্রবাসীদের যোগাযোগের মাধ্যম শুধু চিঠিই ছিলো তখন এই ব্যপার কিছুটা বুঝেছিলাম। চিঠি লিখতে লিখতে কখনো কাঁদতাম, কখনো হাসতাম। অনেক বছর হলো, চিঠি লিখার যুগ বলতে গেলে শেষই। এখন সে-সব দিনও প্রায় ভুলতে বসেছি। সেই সব অনুভুতিও। ১৯৮৭ সালের প্রথম দিকে নিউ ইয়র্ক আসার পর থেকেই আমি আমার ভাই-বোন এবং আব্বা আম্মার কাছে নিয়মিতই চিঠি লিখতাম। আব্বার কাছে চিঠি লিখলে ভয়ে ভয়ে উত্তরের অপেক্ষা করতাম। চিঠিতে বানানে বা বাক্যগঠনে কোনো ভুল থাকলে পরের চিঠিতে আব্বা সংশোধন’ পাঠাতেন। আমার ভয়টা থাকতো এখানেই।
আমি দেশ থেকে আসা চিঠিগুলো মুল্যবান সম্পদের মতো জমাতাম। অনেক চিঠি জমেছিলো। বহু যত্নে রাখা মুল্যবান সম্পদও অনেক সময় হারিয়ে যায়। কিভাবে জানি আমার সবগুলো চিঠিও এক সময় হারিয়ে গেলো। এমন সময় হারালো, যখন আর চিঠি আসে না, চিঠি লিখি না। চিঠি হারানোর কষ্ট আমার কখনোই যাবে না। আমার জমানো কষ্টগুলোর মধ্যে চিঠি হারানোর কষ্টও একটি। আমার ছেলে শুভ’র কাছেও আব্বা ইংরেজীতে কয়েক টা চিঠি লিখেছিলেন। চিঠি পড়ে আমার ছোট্ট ছেলে অবাক হয়ে প্রশ্ন করতো, ‘মা, তোমার বাবা কিভাবে ইংরেজীতে চিঠি লিখলেন! তিনি তো বাংলাদেশে!” ধীরে ধীরে ছেলেকে আমি বাংলাদেশ এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। বাংলা শিখিয়ে তাকে দিয়ে আব্বা আম্মার কাছে কয়েক লাইনের চিঠি লিখাতাম। দেশে বিদেশে সবাই খুশী আর আমার মনেও তৃপ্তি। দেশের সঙ্গে আমাদের ফোনে যোগাযোগ যখন সহজ হয়ে আসলো, তখন থেকেই চিঠি লেখালেখি বন্ধ। কিন্তু আব্বাকে এখন আর ফোনেও পাওয়া যায় না, পাই না। আব্বা মারা যাওয়ার পর ও বেশ কিছুদিন পর্যন্ত দেশে ফোন করলে ভুল করে আব্বার সংগে কথা বলতে চাইতাম, ভুল ভাঙতো একটা কষ্টের ধাক্কা খেয়ে। আমার ছোটবেলাতে আব্বা যখন শহরের বাইরে থাকতেন, বিশেষ করে ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ এর ধারাবাহিকতায়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক আমার রাজনীতিবিদ বাবা যখন রাষ্ট্র দ্রোহীতার মিথ্যা মামলায় দুই বছর জেলে ছিলেন, এই সময় টা তে মাঝে মাঝে জেলে আব্বার কাছে চিঠি লিখতাম। তখন আমাদের অনেক কষ্ট ছিলো, কিন্তু ছোট হলেও চিঠি তে কষ্টের কথা কিছুই লিখতাম না। আব্বা অনেক বুঝিয়ে জেল থেকে চিঠি লিখতেন। আব্বা জেলে থাকতে থাকতে আমি ক্লাস নাইনে উঠে গেলাম। জেলে বসেও সময়ের হিসাব টা ঠিক ই করতেন। সময়ের সাথে আব্বার চিঠির ভাব এবং ভাষাও বদলাচ্ছিলো। সব শেষ চিঠি টা পেয়েছিলাম ক্লাস নাইনে উঠার পর। আব্বা জেল থেকে বের হয়ে আসার কিছুদিন পূর্বে। লিখেছিলেন, ‘তুমি এখন বড় হয়েছো। মনে রেখো, মানুষ বড় হওয়ার সাথে সাথে তার দায়-দায়ীত্বও বড় হতে থাকে আব্বা’। আব্বার এই চিঠি পেয়ে আমার খুব অভিমান হয়েছিলো, মনে হয়েছিলো আমাকে দূরে ঠেলছেন। আমি বড় হতে চাইতাম না। আজ খুব ইচ্ছা করছে আব্বার কাছে একটা চিঠি লিখি, জানতে চাই, কেমন আছেন তিনি। আমি কেমন আছি একটু জানাই। আব্বা কে আমার অনেক কথা জানানোর আছে। আট বছরে অনেক কথা জমেছে। অনেক হারিয়েছি, অনেক পেয়েছি। কিছুই তো জানানো হয়নি। এখনও কোনো অবসরে, নিরিবিলিতে আমি বাবাকে মনে মনে চিঠি লিখি। আমার বাবা এখন আর আমার চিঠি শোধরে দিতে পারেন না। বাবার কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা থেকে নিজে নিজেই শোধরে নেয়ার চেষ্টা করি। সব পারি না। কিছু ভুল হয়তো থেকে যায়। মনে মনে বাবার কাছে মাফ চেয়ে নেই। আজ আমি সারাদিন বাবার কাছে চিঠি লিখবো। আর আল্লাহর কাছে বাবার জন্য বেহেস্ত চাইবো, মাগফেরাত চাইবো। সকল সময়ই আল্লাহর কাছে চাই, তবুও আজকের দিন টা আলাদা। কান্না আসলে কাঁদবো। একা একা কাঁদতেই আমার ভালো লাগে। আমার বাবার রুহের মাগফেরাত কামনা করি। আল্লাহ উনাকে জান্নাতবাসী করুন। সবাই আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন।