মনসুর আহমেদ চৌধুরী –

অত্যন্ত বেদনা আপ্লুত হৃদয়ে স্মৃতির আ্যলবাম থেকে ক্ষুদ্র কয়েকটি স্মৃতিচারণ করতে চাই প্রয়াত ফারুক আহমেদ চৌধুরীকে নিয়ে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৫৬ সালে। এই কূটনৈতিক সার্ভিসে অত্যন্ত কৃতিত্ব ও সাফল্যের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে দীর্ঘ সময় ধরে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৬৯ সালে ইসলামাবাদে পররাষ্ট্র্‌্র মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে আসেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ সরকারের প্রথম ‘চিফ অব প্রটোকল’ হিসেবে নিযুক্ত হন। যুক্তরাজ্যে ডেপুটি হাইকমিশনার থাকাকালীন তিনি কমনওয়েলথে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৭৬-১৯৭৮ অবধি সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন এবং ১৯৭৮-১৯৮২ পর্যন্ত ঊঊঈ ও বেনেলাক্সে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৮৪-৮৬ সাল অবধি বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন। ১৯৮৭-৯২ পর্যন্ত ভারতে বাংলাদেশ সরকারের হাইকমিশনার পদে দায়িত্ব পালন করে অবসর গ্রহণ করেন।
সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছর ব্র্যাক-এর উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত থেকে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। পেশায় ছিলেন একজন কূটনীতিবিদ, নেশায় ছিলেন একজন লেখক। তার লেখা ১৪টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলো হলো- অনাবিল মুখচ্ছবি (২০১৭); মহা আর্থিক সংকট: কারণ ও পরিণতি (২০১৫); জীবনের বালুকাবেলায় (২০১৪)-বাংলা একাডেমি কর্তৃক সাহিত্য পুরস্কার (২০১৫); রবীন্দ্রনাথ: শান্তির দূত (২০১১); গতকাল সমকাল (২০১১); বিপন্ন পৃথিবী (২০১০); ব্র্যাক উন্নয়নের একটি উপাখ্যান (২০০৭)-সহ লেখক সুবল কুমার বণিক ও সাজেদুর রহমান; জানালায় নানা ছবি (২০০৬); স্মরণে বঙ্গবন্ধু (২০০৪); সময়ের আবর্তে (২০০৪); স্বদেশ স্বকাল স্বজন (২০০২); নানা ক্ষণ নানা কথা (১৯৯৯); প্রিয় ফারজানা (১৯৯৬); দেশ দেশান্তর (১৯৯৪)-বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ কর্তৃক ১৪০১ বঙ্গাব্দে ইতিহাস বিষয়ক শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। তাঁর বইয়ে ফুটে উঠেছে জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও তার দৃষ্টিতে সমাজ, পরিবার, মানুষের নানান সমস্যা ও কল্যাণ।
আত্মীয়তার সূত্রে তিনি আমার চাচা। আমি তাঁর অত্যন্ত স্নেহের ও আদরের অন্যতম ভ্রাতুষ্পুত্র। আমি ঢাকায় দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যখন ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষাগ্রহণ শুরু করি, তখন জিনাত চাচী ও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো। তাঁরা প্রতি তিন বছর অন্তর ছুটিতে দেশে আসতেন এবং তাঁদের উৎসাহ ও প্রেরণা আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার পথে এক বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
ফারুক চাচার সঙ্গে আমার কর্মজীবনে একাধিক মধুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ১৯৭৯ সালে ডড়ৎষফ ঈড়ঁহপরষ ভড়ৎ ঃযব ডবষভধৎব ড়ভ ঃযব ইষরহফ (ডঈডই) সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। খবধফবৎংযরঢ় ড়ভ ঞড়সড়ৎৎড় িশীর্ষক অধিবেশনে আমার একটা পেপার প্রেজেন্টেশন ছিল। চাচা ও চাচী তাঁদের সন্তান আদনান ও ফারজানাকে নিয়ে সেই অধিবেশনে আমাকে উৎসাহ দেবার জন্য উপস্থিত ছিলেন। ২০ বছর পর তাঁর উদ্যোগে ইম্প্যাক্ট জীবনতরী ভাসমান হাসপাতালের দাউদকান্দি ও মারকুলি প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্র্যাক-এর আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন।
ফারুক আহমেদ চৌধুরী ছিলেন খুবই সদালাপী, প্রাণবন্ত, ক্রীড়ামোদি, সংস্কৃতিমনা, শিল্পানুরাগী, সাহসী ও ভোজন বিলাসী ব্যক্তিত্ব। সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার বারকোটে তাঁর আদি নিবাস। তিনি গিয়াসুদ্দীন আহমেদ চৌধুরী ও রফিকুননেছা চৌধুরী (লুভা)-এর ৪ পুত্র ও ২ কন্যার মধ্যে জ্যেষ্ঠ সন্তান। ফারুক আহমেদ চৌধুরী ১৯৫৯ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি জিনাত চৌধুরীর সঙ্গে বিবাহে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির ছেলে আদনান চৌধুরী ব্যবসায়ী ও মেয়ে ফারজানা আহমেদ এফসিএ, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ম্যানিলায় কর্মরত। স্বাস্থ্যের ঘন ঘন অবনতি হওয়ায় একাধিকবার রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে তাঁকে ভর্তি হতে হয়েছিল। সব চেষ্টাকে হার মানিয়ে তার জীবনাবসান হলো ১৭ই মে ২০১৭। কীর্তিমান এই নাগরিকের অনুপস্থিতিতে জাতীয় জীবনে যে শূন্যতা তৈরি হলো তা অপূরণীয়।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি, ইম্প্যাক্ট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn