সরকারের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির সঙ্গে যুক্ত সরকারের এক সচিব ২০১৩ সালে একটি কনফারেন্সের বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত হন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক জেলায় নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য কর্তৃপক্ষ তাকে দুইটি বিজনেস ক্লাসের এয়ার টিকেট দেয়। এর মধ্যে একটি টিকেট তার জন্য ও অন্যটি কেউ যদি তার সঙ্গে যায় ওই ব্যক্তির জন্য। বিমান থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে একদল মানুষ তাকে স্যার স্যার বলতে মুখ দিয়ে ফেনা তুলে ফেলতে শুরু করল। এয়ারপোর্টের বাইরে

বেশ কয়েক সিনিয়র কর্মকর্তা তাকে নেয়ার জন্য জেলা প্রশাসনের দামি জিপ গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। তার লাগেজ ও অন্যান্য জিনিসপত্র সেই মানুষগুলোই বহন করে গাড়িতে রাখে। তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি ঝকঝকে তকতকে ফাইভ স্টার মানের হোটেলে। সেখানেও তাকে কিছু মানুষ গ্রহণ করতে উদগ্রিব ছিল। তারা ঘর্মাক্ত দেহে অপেক্ষা করতে থাকেন। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে নির্ধারিত কনফারেন্স রুমে নিয়ে যাওয়ার পর ওই অতিথির নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সবাই উঠে দাড়ান। কনফারেন্স বিরতির সময় তাকে সুস্বাদু নাস্তা ও চমৎকার কারুকাজখচিত মগে করে কফি দেয়া হয়। এরপর লাঞ্চ, ডিনার ও পরদিন ব্রেকফাস্টে ছিল নানা জাতের খানাপিনা। পাশাপাশি সিনিয়র কর্মকর্তার সেবায় লেগে থাকেন জুনিয়র কর্মকর্তারা। ফাইভ স্টার হোটেলের আয়েশী রুমে বসে ‘স্যার’ কোনো ছবি পোস্ট করা মাত্রই ‘লাইক’ এর বন্যা বয়ে যায়। তোষামোদকারি বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও ব্যক্তিরা নানা কমেন্টস দেন। এনিয়ে জুনিয়র কর্মকর্তারা আলোচনা করেন। স্যারকে কিভাবে আরও খুশি করা যায় এ নিয়ে মিটিং করেন। ওই একই ট্যুরে সচিবের সফরসঙ্গী হিসেবে যান তার ছেলে। কয়েক জন কর্মকর্তা ছেলের খোশামোদে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ছেলে কি পছন্দ করে তা জেনে নেয়ার চেষ্টা করে তারা। ওই সময় সচিবের ছেলের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে রিকুয়েস্ট পাঠিয়ে ফ্রেন্ডলিস্টে তালিকাভুক্ত হয় জুনিয়র কর্মকর্তারা। এরপর যতদিন সচিব পদে তার বাবা ছিলেন ততদিন লাইক বা কমেন্টসের অভাব হয়নি বাবা বা ছেলের। ২০১৫ সালেই ওই দৃশ্যপট বদলে যায়। ওই সচিব অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে যান। নতুন কোন পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়ার অপেক্ষা করতে থাকেন। ওই সময় একই টাইপের কনফারেন্সে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত হন। কিন্তু এবার তার জন্য ইকোনমি ক্লাসের টিকেট পাঠানো হয়। বিমান থেকে নামার পর দেখলেন তাকে রিসিভ করতে কেউ আসেনি। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় একটি ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে গিয়ে দেখলেন একটি তৃতীয় সারির হোটেল তাকে দেয়া হয়েছে। হোটেলে চেক ইন করে নিজের লাগেজ নিজেই হাতে করে রুমে নিয়ে যান। এরপর ট্যাক্সি করে কনফারেন্স সেন্টারে যান। ওই সময় তার জন্য কেউ অপেক্ষা করেনি। শুধু তাই নয়, নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে হলভর্তি রুমে কেউ উঠে দাঁড়াননি। ভ্রমণক্লান্তি কমানোর জন্য তাকে কেউ সুস্বাদু নাস্তা বা এক কাপ কফি বাড়িয়ে দেয়নি। আয়োজকদের একজনের কাছে কফি চাইতে গেলে কফি স্ট্যান্ড দেখিয়ে দেয়া হয় তাকে। কফি দেয়া হয় কাগজের কাপে। ওই সময় ফেসবুকে কনফারেন্সের ছবি পোস্ট করে দেখেন লাইকের সংখ্যা মাত্র ২৫ টি। তার বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়- স্বজন ছাড়া কেউ লাইক বা কমেন্টস করেননি। ওই আমলা দুঃখ করে মানবজমিনকে বলেন, জীবনে অনেক কর্মকর্তার সুখ-দুঃখ দেখেছি। কিন্তু পদবি না থাকলে এমন অবস্থায় পড়তে হয় তা ভাবনায় ছিল না। প্রশাসনের একাধিক আমলা জানান, চাকরিজীবনে ব্যস্ততার কারণে ফেসবুক চালানোর সময় পান না অনেকেই। ফলে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীরা অনেক সময় ফেসবুক অপারেট করেন। ওই সব ফেসবুকে পোস্ট দেয়া মাত্র লাইক, কমেন্টসের বন্যা বয়ে যায়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সিনিয়র আমলাদের ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টেরও একই অবস্থা। কিন্তু পিআরএলে যাওয়ার পর সাবেক কর্মকর্তাদের অফুরন্ত সময় থাকে। ওই সময় তারা ফেসবুকে লাইক ও কমেন্টসের খরায় ভোগেন। আরেক সাবেক এক সিনিয়র আমলার ফেসবুক পেইজ পর্যবেক্ষণ করে লাইকের দৈন্যতা লক্ষ্য করা যায়। প্রতিদিন ওই আমলার সঙ্গে দেখা করার জন্য শতাধিক বড় ব্যবসায়ী ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতেন। স্যার’কে খুশি করতে যারপরনাই চেষ্টা করতেন। কিন্তু এখন আগের অবস্থায় নেই ওই আমলার। নিজের উপস্থিতি জানান দিতে ও ব্যস্ত থাকতে রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছেন কয়েক জন আমলা।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn