এম.এ রাজ্জাক :: একটা সময় ঝাঁক বেঁধে আসা অতিথি পাখির শো শো শব্দে আমরার ঘুম ভাংতো। বুঝতে পারতাম হাওরে অতিথি পাখি আসছে। পাখিরা দল বেঁধে এক জলাশয় থেকে আরেক জলাশয়ে উড়াল দিলে ঝড়ের মতো শব্দ বাড়ী থেকে শুনতাম। কিন্তু এ শব্দ গত কয়েক বছর ধরে আমরা শুনতে পারছিনা।  অতিথি পাখি কম আসছে দেখে পর্যটকরাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ কথাগুলো বলছিলেন, তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওর পাড়ের গোলাবাড়ী গ্রামের মো. সবুজ মিয়া।

সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গুয়ার হাওরটি আন্তর্জাতিক জলাভূমি সংরক্ষণ বিষয়ক কনভেনশন স্বীকৃত দেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট হিসেবে ঘোষিত। অন্যান্য বছরের মতো হাওরে এখনও বিপুল পরিমাণ অতিথি পাখি না আসায় পর্যটকরা হতাশ।  হাওর পাড়ের মন্দিয়াতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সানজু মিয়া বলেন, এ বছর টাঙ্গুয়ার হাওরে অতিথি পাখির আগমন খুবই কম। আগে হাওরের বিল-জলাশয়-কান্দায় ডিসেম্বর মাস এলে পাখির মধুর কলকাকলিতে মুখরিত হতো। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা এসে এবার পাখি দেখতে না পেয়ে হতাশ হচ্ছেন। তরং গ্রামের দেলুয়ার তালুদার জানায়, শীত মৌসুমে টাঙ্গুয়ার প্রধান সৌন্দর্য অতিথি পাখি। কিন্তু এবার এখনও অতিথি পাখি না আসায় টাঙ্গুয়ার সৌন্দর্য অনেকটা ম্লান। সে আরো জানায়, নির্মিত ওয়াচ টাওয়ারে উঠে পাখি না দেখতে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে হাওরে আসা পর্যটকদের।

পাখি না আসার কারন হিসেবে স্হানীয়রা জানান, টাঙ্গুয়ার দায়িত্বে থাকা আনসার, কমিনিউটিগার্ড ও নৌকার মাঝিদের ম্যানেজ করে রাতের আধারে টর্চ লাইট, জাল ও বিষটোপ দিয়ে পাখি শিকার করার ফলে এ হাওর থেকে পাখিরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ।  পাখি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের কর্মকর্তারা জানান, জানুয়ারি মাসে অতিথি পাখির আগমন কম দেখা গেলেও ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে তা বাড়বে। হাওর পাড়ের গ্রামবাসী জানান, টাঙ্গুয়ার হাওরে নানা প্রজাতির জলাবন, হিজল কড়চ, নলখাগড়ার বন কমে যাওয়া, শ্যালো মেশিনের শব্দে এবং চোরাই শিকারিসহ নানা কারণে অতিথি এখন পাখি কম আসছে। ভবিষ্যতে সাবধান না হলে এবং কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পাখির আগমন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাবে বলে  তারা জানান ।

আইইউসিএনের পাখি বিজ্ঞানীদের মতে, টাঙ্গুয়া হাওরে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় প্রায় ২১৯ প্রজাতির পাখি রয়েছে। পৃথিবীর বিলুপ্তপ্রায় প্যালাসিস ঈগল রয়েছে। কালেম, পানকৌড়ি, ভূতিহাঁস, পিয়ংহাঁস, খয়রাবগা, লেঞ্জাহাঁস, নেউপিপি, সরালি, রাজসরালি, চখাচখি, পাতি মাছরাঙা, পাকড়া মাছরাঙা, মরিচা ভূতিহাঁস, সাধারণ ভূতিহাঁস, শোভেলার, লালশির, নীলশির, পাতিহাঁস, ডাহুক, বেগুনি কালেম, গাঙচিল, শঙ্কচিল, বালিহাঁস, ডুবুরি, বক, সারসসহ প্রায় ২১৯ প্রজাতির দেশি-বিদেশি পাখি রয়েছে। এর মধ্যে ৯৮ প্রজাতির পরিযায়ী, ১২১ প্রজাতির দেশি ও ২২ প্রজাতির হাঁসজাত পাখি। এ ছাড়া ২০১১ সালের জরিপে টাঙ্গুয়ার হাওরে ৬৪ হাজার পাখির অস্তিত্ব ছিল। এতে ৮৬ জাতের দেশি এবং ৮৩ জাতের বিদেশি পাখি ছিল।

ঢাকা থেকে টাঙ্গুয়া হাওরে পাখি দেখতে আসা বদরুল আলম জানান, অতিথি পাখি প্রতি বছর ডিসেম্বরের শুরুতে দল বেঁধে হাওরের জলে কেলি করে। দল বেঁধে কান্দা জাঙ্গালের গাছের ডালে ডালে সঙ্গিনী নিয়ে ওড়াউড়ি করে। কখনো বা নলখাগড়ার বনসহ অন্যান্য জলাবনের ভেতরে ঢুকে খাবার খাওয়ার দৃশ্য দেখার কথা থাকলেও এ বছর এ দৃশ্য এখনও দেখা যাচ্ছে না।  বুধবার টাঙ্গুয়া হাওরের পাখির অভয়াশ্রমখ্যাত লেচুয়ামারা ও বেরবেরিয়া জলাশয়সহ ইকইরধাইড়, বিয়াসখালি, রৌয়া, রুপাভুই, হাতিরগাতা, চটাইন্ন্যা জলাশয়ে গিয়ে দেখা যায়, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর পাখির সংখ্যা খুবই কম। গোলাবাড়ী কান্দায় পাখি দেখার নির্মিত ওয়াচ টাওয়ারে উঠে পাশের লেচুয়ামারা-রৌয়া বিলে আশানুরূপ পাখি দেখা যায়নি। তবে, ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা গেছে একশ্রেণির পাখি শিকারি নলখাগড়া বনের ঝোপে ও পানিতে ফাঁদ পেতে রাখতে ।

তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদ্মাসন সিংহ বলেন, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এ বছর অন্য বছরের তুলনায় হাওরে অতিথি পাখি একটু কম । গতকাল (মঙ্গলবার) এক পাখি শিকারীর কাছ থেকে একজন একটি পাখি ক্রয় করে নিয়ে আসার পথে তাকে আটক করে জরিমানা নিয়ে মুছলেখা রেখে পাখিটি অবমুক্ত করে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যাতে পাখি শিকারীরা পাখি ধরতে না পারে সে ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসন কঠোর রয়েছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn