ভূমি ও আশ্রয়হীন মানুষদের জন্য একদিনে ৬৬ হাজারেরও বেশি ঘর-জমিসহ হস্তান্তর করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রায় সারা দেশের জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ের প্রান্তিক মানুষ এই ঘর এবং জমির উপকারভোগী। একদিনে সারা দেশে সরকারি ঘর ও জমি হস্তান্তর অনুষ্ঠান ঘিরে ছিল এক উৎসবের আমেজ। ভিটেমাটিশূন্য মানুষদের নতুন এই আশ্রয় তাদের জন্য নিয়ে এসেছে এক আনন্দের বার্তা। ঘর এবং জমি পেয়ে খুশি এই মানুষজন এখন তাদের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন সাজাতে ব্যস্ত। গতকাল ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘর হস্তান্তর অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপকার-ভোগীদের সরাসরি ঘরের চাবি হস্তান্তর করেন। এতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অংশ নেন।
ঠিকাদার নিয়োগ ছাড়া স্থানীয় প্রশাসন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ঘর হস্তান্তর অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সকলের জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করাই হবে মুজিববর্ষের লক্ষ্য, যাতে দেশের প্রতিটি মানুষ উন্নত জীবন-যাপন করতে পারে। দেশের ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে ঘর দিতে পারার চেয়ে বড় কোনো উৎসব আর কিছুই হতে পারে না। তিনি বলেন, এভাবেই মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে সমগ্র বাংলাদেশের গৃহহীনদের নিরাপদ বাসস্থান তৈরি করে দেয়া হবে যাতে দেশের একটি লোকও গৃহহীন না থাকে। যাতে তারা উন্নত জীবনযাপন করতে পারে, আমরা সে ব্যবস্থা করে দেবো। যাদের থাকার ঘর নেই, ঠিকানা নেই আমরা তাদের যেভাবেই হোক একটি ঠিকানা করে দেবো।
অনুষ্ঠানে ৬৬ হাজার ১৮৯টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে জমি ও গৃহ প্রদান করা হয় এবং একই সঙ্গে ৩ হাজার ৭১৫টি পরিবারকে ব্যারাকে পুনর্বাসন করা হয়। গণভবনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং সারা দেশের ৪৯২টি উপজেলা-প্রান্ত ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত ছিল। সরকার মুজিববর্ষ উপলক্ষে গৃহহীনদের জন্য ১,১৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬৬,১৮৯টি বাড়ি নির্মাণ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন আশ্রয়ণ প্রকল্প মুজিববর্ষ উদযাপনকালে ২১টি জেলার ৩৬টি উপজেলায় ৪৪টি প্রকল্পের অধীনে ৭৪৩টি ব্যারাক নির্মাণ করে ৩,৭১৫টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করছে। ইতিমধ্যে সারা দেশের ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এ তালিকা অনুযায়ী গৃহ নির্মাণ ও পরিবার পুনর্বাসনের কার্যক্রম চলবে।
উপকারভোগী প্রতিটি পরিবারকে ২ শতক জমির রেজিস্ট্রার্ড মালিকানা দলিল হস্তান্তরসহ নতুন খতিয়ান এবং সনদ হস্তান্তর করা হয়। প্রতিটি জমি এবং বাড়ির মালিকানা স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি দুই রুমের সেমিপাকা টিনশেড বাড়িতে রান্নাঘর, টয়লেট, বারান্দাসহ বিদ্যুৎ ও পানির নাগরিক সুবিধা রয়েছে। গ্রোথ সেন্টারের পাশে হওয়ায় প্রকল্প এলাকায় পাকা রাস্তা, স্কুল, মসজিদ-মাদ্রাসা এবং বাজার রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুজিববর্ষের অনেক কর্মসূচি আমাদের ছিল। করোনার কারণে আমরা সেগুলো করতে পারিনি। তবে, করোনা একদিকে আশীর্বাদও হয়েছে। কারণ আমরা এই একটি কাজের দিকেই নজর দিতে পেরেছি। আজকে এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় উৎসব। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে তারপরও সীমিত আকারে আমরা করে দিচ্ছি এবং একটা ঠিকানা আমি সমস্ত মানুষের জন্য করে দেবো। কারণ আমি বিশ্বাস করি যখন এই মানুষগুলো ঘরে থাকবে তখন আমার বাবা এবং মা- যারা সারাটা জীবন এদেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন তাদের আত্মা শান্তি পাবে। শেখ হাসিনা বলেন, লাখো শহীদ রক্ত দিয়ে এ দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, তাদের আত্মাটা অন্তত শান্তি পাবে। কারণ এ দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করাটাই ছিল আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের একমাত্র লক্ষ্য।\
তিনি বলেন, আজকে আমি সবচেয়ে খুশি যে এত অল্প সময়ে এতগুলো পরিকারকে আমরা একটা ঠিকানা দিতে পেরেছি। এই শীতের মধ্যে তারা থাকতে পারবে। কেননা আমাদের যারা শরণার্থী তাদের জন্যও আমরা ভাসানচরে ঘর করে দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়ার ক্ষমতায় থাকাকালীন ’৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদেরকেও কক্সবাজার এবং পিরোজপুরে আমরা ফ্ল্যাট করে দিয়েছি অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্তদেরকেও ঘর করে দিয়েছি এবং সেখানে শিগগিরই আরো ১শ’টি ভবন তৈরি করা হবে। প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার কাঠালতলা গ্রাম, নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুর গ্রাম, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার উপকারভোগীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সারা দেশের বিভিন্ন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা উপকারভোগীদের মাঝে বাড়ির চাবি এবং দলিল হস্তান্তর করেন। পিএমও সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া ভিডিও কনফারেন্সটি সঞ্চালনা করেন। প্রধানমন্ত্রী এই স্বল্প সময়ে সফলভাবে গৃহনির্মাণ এবং কাগজপত্র তৈরির মতো জটিল কাজ ঠিকাদার নিয়োগ না দিয়ে সম্পন্ন করতে পারায় জেলা প্রশাসন এবং তার দপ্তর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এত দ্রুত সময়ে পৃথিবীর কোনো দেশে কোনো সময় কোনো সরকার একসঙ্গে ৬৬ হাজার ১৮৯টি ঘর করে দিয়েছে কি-না আমার জানা নেই। যেহেতু যারা প্রশাসনে রয়েছেন তারা সরাসরি ঘরগুলোর তৈরি করেছেন তাই সম্ভব হয়েছে এবং মানসম্মত হয়েছে, সেজন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’ এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের সরকারি কর্মচারীরা যেভাবে সব সময় আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছেন এটা অতুলনীয়। আর সেই সঙ্গে আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়র থেকে শুরু করে সকলে সহযোগিতা করেছেন। এই একটি কাজে আমরা দেখেছি সকলের সম্মিলিত প্রয়াস। তাই আজ আমরা এত বড় একটা দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি।’
তিনি বলেন, এই গৃহায়ন প্রকল্পে কোনো শ্রেণি বাদ যাচ্ছে না, বেদে শ্রেণিকেও আমরা ঘর করে দিয়েছি। হিজড়াদের স্বীকৃতি দিয়েছি এবং তাদেরকেও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দলিত বা হরিজন শ্রেণির জন্য উচ্চমানের ফ্ল্যাট তৈরি করে দিচ্ছি। চা শ্রমিকদের জন্যও করে দিয়েছি- এভাবে প্রত্যেকটা শ্রেণির মানুষের পুনর্বাসনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে জয়যুক্ত করায় পুনরায় জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নৌকা মার্কায় ভোট পেয়েছিলাম বলেই জয়ী হয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করতে পারলাম এবং পুনরায় আমাদের প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন শুরু করলাম।’
করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বের স্থবিরতায় ঘরগুলো হস্তান্তরকালে সশরীরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে না পারার আক্ষেপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইচ্ছা ছিল নিজ হাতে আপনাদের কাছে বাড়ির দলিলগুলো তুলে দেবো। কিন্তু এই করোনাভাইরাসের কারণে সেটা করতে পারলাম না। তবে, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলেছিলাম বলেই আপনাদের সামনে এভাবে হাজির হতে পেরেছি।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
৬৩ বার