শামীম আজাদ-তখন আমি ছিলাম বিচিত্রার একমাত্র নারী সাংবাদিক। সেটা আশির দশকের গোড়ার দিক। কিংবদন্তী সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী আমাদের পাইলট। আমাদের পুরো গুচ্ছটি পোক্ত হয়ে ছিল শাহরিয়ার কবীর, চিন্ময় মুৎসুদ্দি, কাজী জাওয়াদ, আলমগীর রহমান, আনু মুহাম্মদ, মাহমুদ শফিক, চন্দন সরকার ও আমাকে নিয়ে। আমরা সবাই তরুণ। সবাই সম্ভাবনাময়, সবাই তুখোড় এবং দুর্বার। আমাদের একেকটি কভার স্টোরি বেরোয় আর সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে ওঠে। মন্ত্রিদের যেমন দপ্তর ভাগ করা থাকে, তেমনি আমাদের শক্তি ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এলাকা ভাগ করে দিয়েছিলেন শাহাদত ভাই- শাচৌ। আটাত্তরে যোগ দিয়েছি বিচিত্রায়। বেশ ক বছরে হাত ঝুনা হয়েছে। অনায়াসে লিখে চলেছি বিচিত্র সব কভার স্টোরি, স্ট্রিপ, এক কলম এবং নিয়মিতভাবে আমার বাহিনী নিয়ে জমিয়ে তুলেছি জীবন এখন যেমন বিভাগ। এটি আমি সম্পাদনা করি। আমার বিষয়গুলো ঠিক আমারই মত। দেখতে শুনতে চাখতে।মধ্যবিত্তের জীবনযাপন, সাস্থ্য, নারী নির্যাতন, নাগরিক জীবনের খাদ্যাভ্যাস, শিশুর জন্য বুকের দুধ, দেশি ফ্যাশন , ঈদের বাজার, দেশের শিক্ষালয়গুলোর ব্যবস্থা কিংবা ঢাকার বিনোদন। এর সবগুলোই ব্যক্তি হিসেবে আমার জীবনাভিজ্ঞতা কেন্দ্রিক। আমি এক সৎ সরকারি চাকুরের কন্যা, মধ্যবিত্ত নারী, স্বামী বিদেশী সিগারেট কোম্পানিতে কাজ করেন, ঢাকা কলেজে অধ্যাপনা করি, দুই সন্তানের মা, সুতি শাড়ি পরি, বাচ্চাদের নিয়ে পার্কে যাই, ফার্স্ট ফুড খাই, নাটক দেখি, আর্ট কলেজে গিয়ে ছবি আঁকাই। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত বা উঠতি মধ্যবিত্ত এরাই বিচিত্রার গ্রাহক। আমাকে তখন এসব অতি গতানুগতিক বিষয়েই পাঠকীয় আগ্রহ তৈরী করার জন্য করতে হয়েছে নানান কৌশল। আমার স্টোরিতে কাব্য এনে, স্যান্ডুইচের গায়ে রোদ ফেলে, টাঙাইল-রাজশাহীর সুতোতে তার বুনন বর্ণনা করে এবং সরেজমিনে তাঁত তুলে আনতে তাঁতের দিকে না তাকিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জে বেনোজলে ডুবন্ত তাঁতের তন্তুর হাহাকার এনে তৈরি করেছি আমার লেখা। কর্মজীবি নারী সাংবাদিক হিসেবে যখন জাতীয় চরিত্রে দেশি পোশাক ফ্যাশন করার প্রাণান্ত করেছি, তখন আমার পুরুষ সহকর্মীরা পোর্ট আনোয়ারার স্মাগ্লিং অথবা যুদ্ধাপরাধীরা কে কোথায় আছে অথবা বিমানের কারচুপি লিখে হিরো হয়ে যাচ্ছে। যা লোকে বেশি খাবে তার এ্যাসাইনমেন্ট আমার আসে না। শা চৌ আমাকে দিয়ে তেমন কোন রিপোর্ট করাননি। আমিতো আর পারবো না ক্রিমিনাল শিবিরে ঢুকে কোনো বদমাশের সঙ্গে এক টেবিলে চা সিগারেট খেয়ে তার কথা বের করতে। অথবা কাজ সেরে রাত দুটো তিনটায় মতিঝিল থেকে একা রিক্সায় ফিরতে। কিংবা তাড়া খেয়ে লাফিয়ে স্ক্রুটারে উঠে পালাতে। মানলাম এ ছিল আমাদের তখনকার সমাজ ব্যবস্থা। কিন্তু আমি আরেকটি দিকের কথা বলছি।

সত্তরের শেষার্ধ থেকে আশির পুরোটা দশক আমি যেভাবে যে বিষয় দেখেছি, লিখেছি তখন ঢাকার কোনো পুরুষ সহকর্মীরা তার খুব কমই করেছেন। পারেননি। কারণ হয়তোবা, ছোটবেলা থেকে গৃহ জীবণের ওই সব অভিজ্ঞতা তাকে ছেলে বলেই কেউ দেয়নি। ত্রুন সময়ে প্রতি মাসে ঋতুমতি হয়ে তাকে নিজেকে অচ্ছুত ভাবতে হয়নি। সন্তান জন্ম দেয়ার মত চূড়ান্ত এক সাহসী কাজের কোনো অভিজ্ঞতাই তার হয় না। এমনকি আজ অবধি বাংলাদেশি খুব নগন্য সংখ্যক পুরুষই আছেন, যারা তার স্ত্রীর প্রসবকালে সামনে থেকে সে প্রক্রিয়া ও কষ্টটুকু প্রত্যক্ষ করেছেন। তাই পুরুষ সাংবাদিকগণ নারী বিষয় নিয়ে লিখলেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গীতেই তা তুলে এনেছেন যা কিনা কখনোই সাংবাদিক- নারীর সমকক্ষ হয় নি। সেখানে নারী এগিয়ে। তাহলে এ ব্যাপারটা দাঁড়ালো এই যে, অভিজ্ঞতা, অভ্যাস, অধ্যাবসায় ও সুযোগ থাকলে সব বিদ্যেই সবাই আয়ত্ব করতে পারলেও কয়েকটি বিষয় চাইলেও পুরুষরা পারবেন না। শাচৌ ব্যাপারটা বুঝতেন। শক্তি কারো কোন কম নেই। আছে তার ভিন্নতা। কিন্তু বাইরের সমাজে তার মূল্যায়ন হত ভিন্ন।নায্যতা পেত না। আমি মনে করি মানুষের কাজের মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি হওয়া সমীচীন- সে কাজটি কে করেছে এবং কি করেছে তার বিবেচনায়। মূল্যায়নের সময় মনে রাখতে হবে তার জৈব উপলব্ধি ও তার অর্জন, তার শক্তি। দৃশ্যমান সংগতি বা সামাজিক সুযোগের কারনে মোকাবিলার শক্তির কাহিনী কেবল পুরষ্কৃত হতে পারে না। এ বড় অনায্য কথা। এ আমাদের সময়ে হয়েছে। এখন তা নবরূপে তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখছে ঠিক তেমনি। বড়ই বেদনার বিষয়। বড়ই বেদনার বিষয়। লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn