নাসরীন রুমু-

কেমন আছেন? প্রশ্ন শুনে হচকচিয়ে উঠলেন ভদ্রলোক।

তার এই হচকচানি দেখে আমিও কিছুটা বিব্রত, কারণ ভদ্রলোককে মোটামুটি ভালোভাবে চিনি, আত্মীয় না হলেও পারিবারিক ভাবে আসা যাওয়া আছে । যাই হোক , তার এই আচরণের কারণ কিছুক্ষণের মধ্যে জানা হলো , তার পাশে অপরিচিত সুন্দরী মানবীকে দেখে। সমুদ্রের রং এর সাথে মিল রেখে মানবীর পোষাকও নীল ছিল,বুঝতে আর বাকি থাকল না তার এই হচকচানির কারণ। আমিও সরে গেলাম তার সামনে থেকে কিন্তু সাথে জন্ম দিল কিছু প্রশ্ন, যার উত্তর হয়ত আমি কখনও জানতে চাইব না, কারও ব্যাক্তিগত বিষয়ে আমার কখনও আগ্রহ থাকে না। তবে এই বিষয়ে পরিষ্কার সে তার পরিবারের সাথে আসেনি, এসেছে ব্যাবসায়িক কাজে সাথে নিয়ে এসেছেন সময় কাটানোর সঙ্গী।

কেনো জানি  তখন আমি এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করছিলাম অথচ আমার সামনে কোরাল আইল্যান্ডের বিশাল নীল সমুদ্র  সাথে আছে আমার সন্তান। নীল সমুদ্রের ছোট ছোট ঢেউ গুলো যেনো ছোটো ছোটো প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছিল। বের হতে পারছিলাম না অস্থিরতা থেকে , উপরের পরিষ্কার নীল আকাশে রোদের ঝলকানিও কম ছিল না।

নীল সাগরের হাঁটু সমান পানিতে দাঁডিয়ে দূর হতে দেখছিলাম নীলের সাথে নীলের গভীর প্রণয়, যেনো একজন অন্য জনের ভালবাসার আলিঙ্গনের গভীরতায়, নেই এক বিন্দু শূন্যস্থান । অথচ যত কাছে যাওয়া যাবে ততই বোঝা যাবে আকাশের ওই নীল আর সমুদ্রের এই নীলের মধ্যে সীমাহীন দূরত্ব। মানব জীবনটাও সেরকম কিছু, দূর থেকে অনেক কিছু পডা যায় না।

প্রথমে যে ভদ্রলোকটির কথা বলেছিলাম তার সাথে আমার পরিচয় ২০১৩ তে, বাচ্চার স্কুলে।দেখে ছিলাম তার সন্তানের প্রতি , অর্ধাঙ্গীনির প্রতি ভালবাসা , কর্তব্য, দায়িত্ববোধ খুব সুন্দরভাবে তা পালন করতে , বাচ্চাদের চাওয়া পাওয়া কোনোটাই অপূর্ণ থাকত না, সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো তার স্ত্রীর কাছ কখনও অভিযোগ শুনিনি,কিভাবে বা করবে তার স্বামী তো কোনো কিছুতে অপূর্ণতা রাখিনি, বরং স্ত্রীকে দেখতাম একটু আলসে, সব কিছুই তার স্বামী তাকে গুছিয়ে দেয় যতটুকু সম্ভব, আমরা যারা তাদের সাথে কাছাকাছি থাকতাম ,ভাবতাম মহিলা কি ভাগ্যবতী ,ভাল একজন স্বামী পেয়েছে…..তার প্রতিএতো খেয়াল!!!!

ভাবছেন , কি অদ্ভুত ?

এখন ভাবছি … আসলে সে ভাগ্যবতী কি না?

অদ্ভুত বলেই আমরা মানব জাতি।

একেক মানুষ একেক ভাবে সুখি হতে চায় , কেউবা সুখি না হয়েও সুখের অভিনয় করে যায়, যাতে  অন্যকে শান্তি দেয়া যায়। কেন না আমাদের যে সমাজ ব্যবস্থা আরেকজনের দুঃখ দেখলে তা দেখে উপকারের চেয়ে উপহাস করে বেশি, তাই অনেকে কষ্ট গুলোকে চাপা দিয়ে সুখের অভিনয় করে যায় , যাতে অন্য কেউ ব্যঙ্গ হাসি দিতে না পারে। এই ধরনের আরেকটি  ঘটনা দেখেছিলাম ,আমার এক কাছের মানুষের ,শুধু দেখেছিলাম, কিছু বলার সুযোগ ছিল না,দেখেছিলাম কতটা ধৈর্য্য নিয়ে মানসিক যন্রণা সহ্য করতে । রূপে ,গুনে , ব্যবহারে কোনো অংশে কম ছিল না মেয়েটির ,এক কথায় আধুনিক মনমানসিকতা পূর্ণ এবং যথেষ্ট স্মার্ট ,এমন কি শশুর বাড়ির মানুষদের প্রতিও ছিল তার ভালবাসা ,কিন্তু তারপরও সহ্য করতে হতো মানসিক যন্ত্রণা , এমন কি শারিরীক অত্যাচার , সেই অত্যাচারে হয়তো গাঢ় জখম হ তনা , কথায় কথায় চলত চড ,থাপ্পর , কিল , ঘুষি অবিরত । তবে মানসিক জখম হতো অনেক বেশি ,অথচ তাকে দেখেছি সব সময় হাসি মাখা অবস্থায়, কোনোভাবে ধরার উপায় ছিল না তার মানসিক যন্ত্রণার কথা , তাকে কখনও উফ করতে দেখেনি,  সবার কাছে সে উচ্ছ্বাসে ভরপুর সুখি মানুষ, কিন্তু আমি দেখেছিলাম তার ফোলা চোখ , চোখের জলে ভেজা চিবুক, একাকিত্বে অবস্থায় তার যন্ত্রণার ছটপটানি, বুঝেছিলাম সেদিন তার মনের হাহাকার, কারণ বিধাতা আমাকে বেশি কিছু না দিলেও এতটুকু বোঝার ক্ষমতা দিয়েছেন মানুষের যন্ত্রণা অনুভব করার দক্ষতা। সেদিন শুধু চেয়ে দেখেছিলাম সুন্দর প্রাণ শক্তিতে ভরপুর মেয়েটি কাঁদছে ,বাচ্চা একটা মেয়ের মতো, আমিও পারিনি আমার চোখের জল লুকাতে।

তার একটাই অপরাধ ছিল সে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, সে আনতে পারিনি বাবার বাডি থেকে কাড়িকাড়ি টাকা বা ফ্ল্যাট বা প্লট। এই জন্য বাবার আদরের মেয়েটির প্রতিদিন শুনতে হতো তার বাবার নাম তুলে গালি,কথায় কথায় শুনতে হয় খোঁচা ।কোনো সন্তান কখনও তার বাবা মাকে নিয়ে কেউ কিছু বলুক তা সহ্য করতে পারে না অথচ এই খোঁচাটা মেয়েদের বেশি শুনতে হয় তার জীবন সঙ্গী থেকে। সেই মেয়েটি  পারিনি নরক ছাড়তে তার বাবা-মা আর সন্তানের জন্য। কারণ সে ডিপেন্ডেন্ট নয় , সন্তান ,সংসারের জন্য সে পারিনি চাকুরি করতে এবং তার বাবা মাকেও জানায়নি তার কষ্টের কাহিনী। সবাইকে সুখে রাখার জন্য সে করে গেছে কঠিন অভিনয়। জানি না বিধাতার কি ইচ্ছা ?

মানব জীবন একটায় , জানি না এখানে তার সুখের দেখা কখনও মিলবে কিনা ,পারবে কিনা সে মুক্ত হতে ?? হতে চায় সে সত্যিকার অর্থে সুখি।

সুখের অভিনয় করা মানুষ গুলো আসলে অসহায় ,তারা বড্ড একা তাদের বন্ধু বলতে কেউ থাকে না, পারে না তার কষ্ট গুলো বিলাতে, বড্ড ভয় পায় পাছে বলা লোক গুলোর অট্টহাসিকে।

কত বিচিত্র আমাদের পৃথিবী, কত বিচিত্র মানব চরিত্র। থাইল্যন্ড সফরের মজার একটা কাহিনী উল্লেখ না করে পারছি না, দেশের বাইরে যখন অবস্থান করি বাংলাদেশের যে কোনো মানুষ কে দেখলে মনে হয় নিজের কাছের কেউ, সেখানে গিয়ে পরিচয় বাংলাদেশের কয়েকটি পরিবারের সাথে, ভালোই লেগেছে এক সাথে ঘুরে বেড়াতে, ঘুরতে ঘুরতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা , হাসি ঠাট্টা । কথা প্রসঙ্গে জানলাম, “আমাদের জাতি অর্থাৎ বাঙ্গালি একজন ,দুপুরের খাওয়ার সাথে অর্থাৎ ভাতের সাথে পানির পরিবর্তে মদ পান করছেন”…এই আমাদের সাথে থাকা এক বাঙ্গালী পরিবারের কাছে অদ্ভুত মনে হয়েছিল , তাই সে বিষয়টি সাথে সাথে ক্যামরাবন্দীও করেছিল ।

পাঠকদের কাছে ব্যাপারটা শুনে কতটুকু  অসামঞ্জস্য  লাগছে জানি না কিন্তু আমার কাছে পুরোটাই অসমাঞ্জস্য। কারণটা বলছি,আমাদের দেশে মদ্য পান করাকে সাধারণত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভাল চোখে দেখে না অনেকেই, এই জন্য যারা মদ্য পানে  অভ্যস্ত তারা লোকচক্ষুর আড়ালে করে, অথচ যেসব দেশে মদ্য পান করার বাঁধা ধরা নিয়ম নেই অর্থাৎ মদ্য পান করা তাদের সংস্কৃতি, ঐসব মদ পান করার জন্য আলাদা বার আছে, ক্লাব আছে অর্থাৎ বৈধতা আছে, অথচ তারা অন্তত অসামঞ্জস্য ভাবে মদ্য পান করে না ,সব কিছুরই একটা নিয়ম আছে, যেমন আমাদের দেশে মুরুব্বিদের সামনে পা তুলে বসা যতখানি বেয়াদবি তেমনি ভাতের সাথে মদ পান করা ততটুকুই অসম্মানের। দু:খ একটাই দেশের বাইরে নিজেদের ছোট হতে দেখতে সত্যি লজ্জাজনক আর কষ্টের। অবাক হওয়ার বিষয় থাইল্যান্ড আমাদের দেশের তুলনায় অতবড় দেশ না , অথচ ওরা আমাদের চেয়ে সব দিকে অনেক উন্নত, নারী পুরুষ সমান তালে কাজ করছে , একজন সাধারণ ফল বিক্রেতা অনেক সুন্দর ও পরিচ্ছন্নভাবে ফল বিক্রি করছে, শপিংমলগুলোতে বেশিরভাগ মেয়েরা কাজ করছে, নেই কোনো হইচই,মুখ জুড়ে শুধু স্বাগতিক হাসি, নেই বিক্রেতাদের প্রতি প্রতারণার কৌশল, যা আমাদের দেশে নতুন বিদেশিদের আসলে পডতে হয়। এক ইটালিয়ান বিদেশিনীর লেখা পড়েছিলাম তিনি এক সিএনজিওয়ালাকে বলেছিলেন শান্তিনিকেতন যাব, সিএনজিওয়ালা বললেন অনেক দূর, ভাড়া লাগবে পাচঁশত , বিদেশিনী বিশ্বাস করে ওঠে পড়লেন , তারপর সি এন জি ড্রাইভার একি জায়গায়  কয়েকবার চক্কর দিয়ে নামিয়ে দিয়ে  বললেন শান্তিনিকেতন । অথচ বিদেশিনী শান্তিনিকেতনের কাছেই ছিলেন।

উন্নত দেশগুলোতে উন্নতি হওয়ার একমাত্র কারণ  তাদের সততা, ভদ্রতা ,পরিশ্রম,কারিগরি শিক্ষা  আর আইন- শৃঙ্খলার সঠিক বাস্তবায়ন । তবে এইটা সত্য  ,দেশ  থেকে  বিদেশ ভ্রমণ করতে যারা যায় ,তারা বিদেশে গেলে  ওখানকার নিয়ম কানুন সঠিক ভাবে অনুসরন করে অথচ আমরা  নিজেদের দেশে নিয়ম কানুন মানতে নারাজ , পালন করি না কোনো দায়িত্ববোধ ,কর্ত্বব্যবোধ। গড্ডালিকা প্রবাহে যেনো গা ভাসিয়ে দেয়। লজ্জার বিষয় হলো , আমাদের দেশে  নতুন গাড়ি  কেনার পর প্রথমে যে কাজটা করতে হয় সেটা হলো , গাড়িতে মোটা বাম্পার লাগাতে হয় ,গাড়ির সুরক্ষা চিন্তা করে লাগানো হয় , যাতে অন্য গাড়ির ঢাক্কা থেকে রক্ষা পায় , আবার পারলে অন্য গাড়িকে  যেনো ঢাক্কা দেওয়া যায় , কিনতু উন্নত দেশ গুলোতে গাড়ি গুলোতে নেই বাম্পার আচ্ছাদিত লোহার পোষাক , নেই হরণের কান ঝাঁঝালো বেসুর আওয়াজ। যেনো সব কিছু একটা সুন্দর শৃঙ্খলের মধ্যে চলছে।

সবশেষে মূল কথা হলো ,যেসব দেশে নারী-পুরুষ সমান ভাবে কাজ করে সে দেশ ততবেশি উন্নত ।  কারণ আমাদের দেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী, এই নারীকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন সম্ভব নয় ।  এক্ষেত্রে স্বামী বিবেকান্দের একটি কথা উল্লেখ না করে পারছি না, “পাখি দুটি ডানা ভর করে আকাশে উড়ে , একটি ডানা যদি অসুস্থ থাকে তাহলে পাখি অন্য ডানা ভর করে উড়তে পারে না, তেমনি মানব জাতিরও দুটি ডানা আছে ,একটি হলো “নর ”  অন্যটি হলো “নারী”, একটি কে ছাড়া অন্যটি অচল” । নর আর নারীর সম্মিলিত রূপ হলো সুন্দর বিশ্ব।

যা বিধাতার পরিকল্পিত সৃষ্টি।।।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn