সেজুল হোসেন(ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে)

সন্ধ্যা। শ্যামলী পরিবহন মাকে নামিয়ে দিলো সায়েদাবাদ টার্মিনালে। সিএনজি নিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম। ফিরছি বাসায়। সঙ্গে ভাবী, ভাতিজি। কাকরাইল মোড় হয়ে প্রধান বিচারপতির বাসাকে বামে রেখে মগবাজারের দিকে এগুচ্ছি। ডিএমপি হেডকোয়ার্টার থেকে একটু একটু জ্যাম শুরু হলো। সিএনজির চাকা ধীরে চলতে চলতে একটা সময় থেমে গেলো। তখন আমাদের অবস্থান হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের গলির মুখ। এতক্ষণ মাকে ধারাবর্ণনা দিচ্ছিলাম, চোখের সামনে যা পড়ছিলো, পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলাম।

জীবনের প্রথম মা ঢাকায়। অন্তত আমার মুখে যে সকল স্থাপনার নাম এর আগে শুনেছেন সেগুলো চেনানোর চেষ্টা করছিলাম। কাকরাইল মোড়ে এসে বামে তাকিয়ে বললাম- ওদিকে এনবিআর। যত বড় ক্ষমতাবানই হোক না কেনো এই প্রতিষ্ঠানকে ট্যাক্সের টাকা বুঝিয়ে দিতে হয়। আর প্রতি বছর যে বাজেট দেয় সরকার সেই টাকার বেশিরভাগই যোগান দেয় এই প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। একটু পরে আইডিইবি ভবন। বললাম কদিন আগে যে স্বর্ণ ধরা পড়লো প্রায় ১৪-১৫ মন। বৈধ কাগজ নাই অথচ রমরমা ব্যবসা করছে সেই স্বর্ণ আটক করে ব্যাংকে জমা রাখছে শুল্ক গোয়েন্দা। তারই অফিস এই বিল্ডিংয়ে। এভাবে একটার পর একটা বিল্ডিং চোখে পড়ে আর মাকে পরিচয় করাই। কিন্তু হলি ফ্যামিলির রাস্তার মুখে জ্যামে আটকে যে দৃশ্য চোখের ১ হাত সামনে এসে পড়লো সেই দৃশ্যের বর্ণনা আমি কিভাবে দিই। মনে মনে ভয়ও পাচ্ছিলাম এমন কোনও দৃশ্যের। যে দৃশ্য দেখে আমি অভ্যস্ত সেই দৃশ্যতো আমার মায়ের কল্পনার ত্রীসীমানায়ও নেই।

মেয়েটা তার পুরুষের কোমর জড়িয়ে বসে থাকলে ভালো ছিলো। মনে মনে মাকে বলতাম, মোটর সাইকেলের পিছনে বসলে এভাবেই বসতে হয়, না হলে পড়ে যাবে। কিন্তু তা না। দুই হাত যথাসম্ভব পেঁচিয়ে মেয়েটা অনেকটা উপুত হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকার মতো ছেলেটার পিঠে লেপ্টে আছে। তার চারপাশে গিজগিজ করছে গাড়ি, মানুষ। আমি বিব্রত ও সংকোচ বোধ করছিলাম আর অনেকদিন পর আল্লাহকে বলছিলাম- এই জ্যামটা একটু দ্রুত ছাড়ান যায় না? কিন্তু না, জ্যাম ছুটলো না। মেয়েটাও শুয়ে থাকলো নির্লজ্জের মতো। মাকে এক পলক ওদিকে তাকাতে দেখলাম। আর দেখলাম কাপড় দিয়ে মুখটা একটু আমার কাছ থেকে ঢাকার চেষ্টা করছেন। যে ঢাকায় আমি থাকি, সেই ঢাকার এমন চিত্র পথে ঘাটে দেখতে হবে তা হয়তো ভাবেননি।

গ্রামে বড় হওয়া মায়ের কাছে- ঢাকা মানে রাজধানী, বড় বড় দালান, বড় লোকের গাড়ি, বড় বড় ডাক্তার, ব্যবসায়ী আর মানুষের ভাগ্য খুলে যাওয়ার পথ দেখানো এক শহর। কিন্তু এতো কিছু পরিচয় করিয়ে দিতে দিতে যে দৃশ্যে আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি, গ্রাম থেকে আসা ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়া আর জীবনেও রক্তের সম্পর্কের বাইরের কারও সঙ্গে কথা না বলা আমার মা, এমন বিব্রতকর দৃশ্য চোখে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন সেটা ভাবলেই গা গিন গিন করে।

লিসেন, আমি মোটেও মূর্খ নই, গ্রাম্য নই, ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরোধীও নই। আমি নির্লজ্জতার বিরুদ্ধে। আপনি ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডে যান। সেখানে অবাধ মেলামেলার সুযোগ আছে। বাবা মায়ের চোখের সামনে মেয়ে তার বয় ফ্রেন্ডকে নিয়ে রুমের দরোজা বন্ধ করে। সেখানে দিনে দুপুরে হাজার হাজার মানুষের সামনে যা তা করলেও কেউ ভ্রুক্ষেপ করে না। কিন্তু আপনি পড়াশোনা কিংবা নগরে বাস করে নিজেকে যতো স্মার্টই মনে করেন না কেনো, অন্তত বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে এমন কোনও দৃশ্য রচনা করবেন না যা দেখলে একজন মা তার ছেলের সামনে মুখ লুকায়।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn