শাহরীয়ার বিপ্লব(ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে)-

ক্লাস ফোর এ পড়ার সময় জুনেদের সাথে বন্ধুত্ত। পাঠশালার সাথী বলা যায়। ওর বাবা বিরাট মোটা মানুষ আমার প্রায় সব ক্লাস ম্যাটেরা জানতো । রফিক স্যার একদিন অভিনয় করে দেখালেন জুনেদের বাবা কিভাবে বিশাল পেটের উপর কাগজ রেখে সই করতেন । উনার নাকি চেয়ার টেবিল লাগত না। পেটেই টেবিলের কাজ হয়ে যেত । মুলত জহুর সাব সম্মন্ধে আমার ধারনা সেই দিন থেকে।

সিক্স থেকে কলেজের শেষ দিন পর্যন্ত জুনেদ, সবুজ, লিপন, প্রমথ ছিল আমার কাছের বন্ধু বা ক্লাসমেট । সেই সুত্রে জুনেদের বাসায় আমাদের সবার যাতায়াত ছিল । আমার বোধ হয় একটু বেশী ছিল। রান্না ঘর থেকে শুরু করে বাসার সবক্ষেত্রেই অধিকার। অনেক সময় খালাম্মা ভাত দিতে দেরী করলে নিজের হাতেই নিয়ে নিতাম। জহুর সাবের শাসন এবং আদর দুটোই অন্যদের চাইতে বেশী পেয়েছিলাম মনে হয়। এই সময়ে পারিবারিক জীবনে উনার সততাএবং অভাবও দেখেছি খুব কাছে থেকে।
উনার জীবনের অনেক বিচিত্র ঘটনা ও কাহিনী শুনার সৌভাগ্য হয়েছে আমার।

৯১ বা ৯২ সাল, জহুর সাব তখন বিরোধী দলের এম,পি । থাকেন নাখালপাড়া হোস্টেলে । রোজার মাসে ইফতারের সময় কলা খেয়ে উনার ফুড পয়জনিং হয়েছে, ডাক্তার পি,জি হাসপাতালে ভর্তি করালেন। সাথে জুনেদ আর আমি। ২/৩ দিন পরে একটু সুস্থ হলে জুনেদ আমাকে রেখে চলে গেল। ভি,আই,পি কেবিনে উনার পাশের সিটে আমি। রাতে হঠাৎ হঠআত উনার ঘুম ভেঙ্গে যেত । বিছানায় চিত হয়েই ডান বাম না দেখে উপরের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করতেন,
অবা হজাগ আছ নি?
মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পরলে উনি বিরক্ত হয়ে বলতেন তুমরারে দিয়া কুন্তা অইত না। তোমরা খালি ঘুমাইতায় হিখছ।
মাঝে মাঝে দেখতাম উনি নিজে নিজেই ঠাস ঠাস করে দুই হাতে মশা মারার চেষ্টা করছেন, কিন্তু একটা মশাও মারতে পারতেন না। মশা মারার ব্যর্থতার কথা বলতেন একটু লাজুক হাসি দিএ ,
বুজছনি বা একটা মশাই মারতে ফারলাম না জীবনে, কিতা আর এম,পি গিরি খরাম। বাদ দিলাও মশা মারা, খাইলাওক কিছু রক্ত, মাইনসে খাইলে মসারাও খাওক।

এরপর আর ঘুম হয় না, গল্প বলেন। জীবনের গল্প, রাজনীতির গল্প, মাঝে মাঝে ঘুমান, ভীষণ শব্দ করে নাক ডাকেন , আবার কিছু সময় পরে উঠে পুরনো গল্পের রেশ টেনে নতুন করে আবার শুরু করেন, হুঞ্ছ নি বা, , , , , , ।

সিগারেট টানতেন শুয়ে শুয়ে । সিগারেটের শেষ অংশটা দিয়ে বলতেন, ধরো , বাইরে ফালাইয়া আও।
একদিন, বাইরে থেকে আসতে আমার কিছুটা দেরী হল, মুখ গম্ভীর করে বলেন,
ফালাইতে গিয়া নিজেই টাইন্যা আইলা নি?
জী না চাচা , আমি এইতা খাই না।
আর মিছা মাইত্ত না, নিজের ফুলারে ফালাইতে দিলে তুলা মুলা সুদ্দা খাইলায়। তুম্রার কোন বিশ্বাস আছে?

প্রায় প্রতি রাতেই উনার জীবনের অভিজ্ঞতার কথা শুনতে হত, না শুনলে রাগ করতেন, তুমি কিতা খলি ঘুমাইতে আইছনি?

একদিন আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, চাচা, আফনে ২/৩ বার এম,পি অইছইন, বঙ্গবধুর আমলেও এম,পি আছলা, খতো মাইনসে খতো টেখা বানাইল আর আফনে খেনে ফারলা নায়? আফনার ত কুন্তা নাই।
তিনি রাগ করে বললেন, জুনেদ মিয়ারও একই খতা , টেখা বানাইলাম না খেনে, আমরা কিতা টেখা বানাইবার লাগি এম,পি অইছি নি? আমরা মরি গেলে তোমরা বানাইও। খেও দেখত নায়, বুচ্চ নি?

আমি নিরুত্তর, কিছু বলছি না। অনেক্ষন পরে তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাকে ডাকলেন ,
অব হজাগ আছ নি?
জী ,আছি।
হূনও তমারে এখটা সপ্ন খই, মন দিয়া হূন ।
বঙ্গবুন্ধুর আমলে আমি তখন এম,পি। ডাইনে বামে সবে খালি মাল বানাইতাছে, রাতারাতি অনেক মানুষ আঙ্গুল ফুইল্লা খলাগাছ অইতাছে, আমি চিন্তা খরলাম আমিও কিছু খামাই। নতুন কিছু পারমিট নিয়া মিনিসট্রি তে জমা দিছি। পরের দিন পাস অইব আর আমি বাক্কা কিছু টেখা পাইমু। রাইতে ঘুমাইছি, সপ্নে দেখি, আমার ওস্তাদ মনউয়ার আলি সাব, তাইনের হাতের বেখা লাঠি লইয়া আমার মাথার মধ্যে খালি মারতাছে, আর খইতাছে জহুর , জহুর, তুই চুর ,তুই চুর। বারি খাইতে খাইতে আমার ঘুম ভাঙ্গে। সারারাত আর ঘুমাইছিনা। পরের দিন মিনিস্ট্রি ত না যাইয়া সোজা আইছি বারিত। আর কোনও দিন দুই নন্মরি চিন্তা খরছি না ।
বুঝছনি বা , বলতে বলতে তিনি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভান করলেন, চোখের নীচ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরতে লাগলো ।

(২২ মে ,জহুর সাবের মৃত্যু বার্ষিকী গেল, সম্ভবত। হৃদয়ের সকল শ্রদ্ধা পিতৃতুল্য এই সৎ মানুষটিকে )

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn