শামীম আজাদ ।।

কয়েক বছর আগেও রাতে ঘুম ভাঙলে উঠে পানি খেতাম। লাইট জ্বেলে বেড সাইড টেবিলে দেখতাম ক’টা বাজে। চলমান কোনো বিশ্ব ঘটনা বা দেশের কোনো দুর্ঘটনার সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য ঘুম চোখে হলেও বিছানা থেকে বাধ্য হয়ে উঠে গিয়ে রেডিও বা টিভি ছাড়তাম। নিউজের স্ক্রলে না থাকলে হাত কামড়াতাম। ভাবতাম পত্রিকার অফিসে যে বন্ধুটি কাজ করে তার ঘুম ভাঙাবো কিনা। এখন লেপের ভেতর থেকে হাত বার করে স্মার্ট ফোন নিই। রসদ নেবার জন্য চার্জারে রাখা থাকলে তার লেজ খসিয়ে আবার লেপের ভেতর প্রবেশ করি। বালিশের নিচ থেকে নিয়ে চশমাটা পরে নিই। বাতিও জ্বলাতে হয় না। মোবাইলের নিজস্ব আলোতে হাতের মুঠোতেই জেগে ওঠে বিশ্বচরাচর। পেয়ে যাই সিলেটের মুরুজপুর থেকে নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের দেশ বিদেশের সকল সময় ও সংবাদ।

ইচ্ছে হলে পছন্দমতো অনলাইন পত্রিকা পড়ে নিতে পারি সর্বশেষ খবর। দরকার বুঝলে ব্লগে গিয়ে পড়া যায় নির্বাচন পর্যালোচনা। আর জনগণের প্রতিক্রিয়া দেখতে হলে বা বন্ধুদের মতামত জানতে হলে এবং বাকি ঘুম জলাঞ্জলি দিতে চাইলে ক্লিক করে প্রবেশ করি ফেসবুকে। এখানে বৈশ্বিক বন্ধুবান্ধব থাকলে এক মুহূর্তে জানা হয়ে যায় সে যেখানে বা যে দেশে আছে তাদের তাজা খবরের প্রতিক্রিয়া। এখানে যেকোনো স্থান থেকে সমান খবর পাওয়া যায় অনেক সময় ‘লাইভ’ও দেখা যায়। প্রয়োজনে ম্যাসেঞ্জারে কথা বলা যায়। সেখানে রীতিমতো দলেবলে আড্ডা ও কাজের মিটিং সারা যায়। একটি দুর্ঘটনা হলে জঙ্গি আক্রমণ হলে বা বোমা ফুটলে এখন যে কারো বদৌলতে দেখা যাচ্ছে লাইভ। হলি আর্টিজানের সর্বশেষ সংবাদ এবং কাদের মোল্লার রায়ের জন্য ২৪ ঘণ্টা ঐ মোবাইলই ছিল এক ব্রিটিয়ান্ট সংবাদ পরিবেশক। অথচ এরশাদের স্বৈরশাসনের অবসানে গণআন্দোলনে এবং আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য খবরের কাগজ, সাপ্তাহিক সাময়িকীই ছিল সেই অস্ত্র। লোকজন পত্রিকা অফিসের সামনের দেয়ালে আটা লাগানো খবরের কাগজ ঠেলাঠেলি করে পড়েছে। আজ ভেবে অবাক লাগে কখন এই বৈদ্যুতিক মাধ্যম হয়ে গেল বিকল্প সংবাদ মাধ্যম!

তবে অবাক হবার কিছু নেই। গোটা পৃথিবীই ছুটছে প্রযুক্তির পিছনে পাল্লা দিয়ে। আমাদের সরকার ব্যাপারটা সুলভ করে বিদ্যাশিক্ষা থেকে সংবাদের দ্বার খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের চার কোটি মানুষ নাকি ফেসবুক ব্যবহার করেন। এবং এর বেশিরভাগ বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম। ভাবুন! এরাই আবার জনসংখ্যার মূল জনভাগ। সামাজিক বিপ্লব কিন্তু এরাই ঘটায়। এই যৌবনেই তো যুদ্ধে যাবার কথা। দেখা গেছে এই মাধ্যমেই খোঁজখবর নিয়ে, এই ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমেই আবেদন করে আমাদের দেশের আধা কোটির মতো মানুষ আজ ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত বিশ্বে। কাজ করছে। আয় করছে বিদেশি মুদ্রা। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও তার বিদেশে জাগ্রত সন্তানের দেশের সকল খবর পাচ্ছে এখানেই।

এ আবার এমন এক মাধ্যম যে মুহূর্তেই বিশ্বের যে কোন স্থান থেকে যে কেউ পাঠিয়ে দিচ্ছে খবর। আটকে পড়ছে না কোন সংবাদ। এমনকি দুর্ঘটনা কবলিত মানুষের মোবাইল থেকেও উদ্ধার করা যাচ্ছে সর্বশেষ আশঙ্কা বা অবস্থা। সংবাদের জন্য এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয়তা এখন ব্রডশিট কাগজ, টিভি ও রেডিওর চাইতে বেশি। সামাজিক আন্দোলনেও কোন কোন ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব দেখা গেছে এখন সংবাদপত্রের চেয়েও ফলপ্রসূ হচ্ছে। এমনকি এখন জাতীয় সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যমও ফেসবুক ফলো করে তার জন্য বরাদ্দ করছে পাতা, করছে সেখান থেকেই সংবাদ ও তার ফলো আপ। সংবাদ ব্যপারটা এমনই স্পর্শকাতর যে ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যাওয়া বানোয়াট খবরও জনরোষ জাগিয়ে তুলছে।

ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে নিরীহ মানুষের। সেটাও এই বিকল্প মাধ্যমেই সবার আগে কোন নিজস্ব সংবাদদাতা ছাড়াই এসে যাচ্ছে। তখন ‘মূলধারার’ গণমাধ্যম তা লক্ষ্য করে সংবাদ করতে বাধ্য হচ্ছে। এমনকি ঘটনার একটা সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সংবাদপত্রকেও প্রবল চাপের মধ্যে রাখছে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এর আওতায় পড়ছে ফেসবুক, বস্নগ, টুইটার, লিঙ্কডইন, ইন্সট্রাগ্রাম, স্কাইপি, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, অনলাইন সংবাদপত্র ইত্যাদি। এখন গণমাধ্যম বললে এই সামাজিক মাধ্যমগুলো বাদ দিয়ে কথা বলা যাবে না। ধারণা করি এই বিকল্প মাধ্যমের জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ সংবাদপত্রের নৈতিকতা। আজ তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বারবার। এ শুধু আমাদের দেশে না সারা দুনিয়ায়ই অনুরূপ অবস্থা। সে কারণেই বিশ্বরাজনীতির খেলা এবং শক্তিমান দেশের আগ্রাসনগুলোর কারণগুলো দেখা যায়। দেশে আগে যেখানে এই নৈতিকতার প্রশ্নে পত্রিকাকে বিদ্ধ করতে গেলে আমরা সরকারকে দায়ী করতাম।

সরকারি বিজ্ঞাপনই ছিল তাদের প্রধান সহায়। আর তার সূত্রে পার্ট অ্যান্ড পার্সেল হিসেবে তাদের ঘাড়ে আসতো বিধিনিষেধও। এখন তা বিদ্যমান তো রয়েছেই তার উপর দেখা গেছে অধিকাংশ টেলিভিশন ও সংবাদপত্রই কোন না কোন বিত্তবান বা ব্যবসায়ীচক্র বা ধনকুবেরের অর্থায়নে চালিত হচ্ছে।

এতে সমস্যা যা হয়েছে তা হলো রাজনৈতিক মতাদর্শ ও সামাজিক পর্যালোচনাও সে মাধ্যমের মতাদর্শের বাইরে যেতে পারছে না। মতের মিল না হলে কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী যেমন পরিতাজ্য হচ্ছেন তেমনি আবার কেউ কেউ তাদের কাছে মহাজনপ্রিয়ও হয়ে উঠছেন। অথচ জনগণ খেলাটি ঠিকই ধরতে পারছেন। এবং তারপর তারা তা বর্জন করছেন অথবা বিনোদনের জন্য খেলা দেখছেন কিন্তু আসল ব্যাপার জানতে খুলে ধরছেন ল্যাপ্টপ বা মোবাইল। তাহলে সত্যিকার অর্থে দেশের ও জনমানুষের স্বার্থে যারা কথা বলছেন তারা যাচ্ছেন কোথায়? তারা চলে আসছেন এই নয়া বিকল্প সংবাদ মাধ্যমে। ভেবে দেখুন বর্তমানে সুন্দরবন বাঁচানোর জন্য দেশজুড়ে যে বিশাল আন্দোলন চলছে তার কতটুকু আপনি প্রচলিত গণমাধ্যমে পাচ্ছেন আর কতটা পাচ্ছেন ফেসবুক, স্কাইপিতে?

আর যেহেতু এখানে সব জাতপাত ধর্মনীতি ও গীতির মানুষ আছেন তারা তাদের আগ্রহের বিষয়কে ভাগাভাগি করে জাগিয়ে দিচ্ছেন সবাইকে। এ অনেকটা বুনো আগুনের মতো। একবার লাগলে থামানো মুশকিল। ফলে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই হয়ে উঠেছে ‘সরকারের একমাত্র বিরোধী দল’। এর আরেকটা সুবিধা হলো প্রযুক্তির অসাধরণ সহজিয়া উন্নয়ন। এটা বুঝতে ও ব্যবহার করতে হলে পিএইচডিধারী হতে লাগে না। সাধারণ বিদ্যালয়ের যোগ্যতাই যথেষ্ট। ফেরিওয়ালা থেকে ফড়িয়া, চক বাজারী থেকে চাষী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই ধুমিয়ে ব্যবহার কর।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn