শামছুদ্দীন আহমেদ-
 ‘শিগগিরই আমরা মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করব, আমিও পদত্যাগ করব, আমার দলের মন্ত্রিরাও পদত্যাগ করবেন’-গত প্রায় দুই বছর ধরে জাতীয় পার্টি (জাপা) চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ মাঝে-মধ্যেই এরকম বলে আসলেও দলটির দায়িত্বশীল নেতারা জানালেন, জাপা মন্ত্রিসভা ছাড়ছে না। এ বছরের ডিসেম্বরে একাদশ সংসদ নির্বাচন হলে সংবিধান অনুযায়ী আগের ৯০ দিন অর্থাত্ অক্টোবর থেকেই ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ গঠন করা হবে। পাটিগণিতের হিসাবে নির্বাচনকালীন সরকারের আগে এ সরকারের হাতে আছে মাত্র ছয় মাস। জাপার গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব পর্যায়ে কথা বলে এটা মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে যে এই ছয় মাসের মধ্যে মন্ত্রিসভা থেকে জাপার বের হয়ে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। পদত্যাগ তো করছেই না, বরং নির্বাচনকালীন সরকারেও থাকতে চায় জাপা। কৌশলে সেটি অনেকটা খোলামেলাই বলে দিয়েছেন জাপা চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ। ঢাকঢোল পিটিয়ে ও প্রায় সারাদেশ থেকে নেতা-কর্মী-সমর্থক জড়ো করে গত ২৪ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত দলটির সমাবেশে এরশাদের বক্তব্যের মূল বার্তাই ছিল, বর্তমান সংসদে যেসব দল রয়েছে তাদের প্রতিনিধি নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে। যার পরিষ্কার অর্থ-নির্বাচনকালীন সরকারের সময়েও মন্ত্রিসভায় থাকার দাবি তুললেন এরশাদ। অতীতের ঘটনাপ্রবাহ টেনে জাপার দায়িত্বশীল নেতারা  জানান, এরশাদ বরং নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় আরও বেশি সংখ্যক মন্ত্রী চাইবেন।
 
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকারে জাপার দুইজন পূর্ণ মন্ত্রী, পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদায় দুইজন উপদেষ্টা ও একজন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। এমনকি জাপা তখন সংসদের প্রধান বিরোধী দলও ছিল না, প্রধান বিরোধী দল ছিল বিএনপি। আগামী ছয় মাসে মন্ত্রিসভা থেকে জাপার বেরিয়ে আসার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না দলটির কো-চেয়ারম্যান ও এরশাদের সহোদর জিএম কাদের। মিডীয়ার সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আমাদের দলের প্রেসিডিয়াম সভা ও সংসদীয় দলের সভায় বহুবার সিদ্ধান্ত হয়েছে আমরা মন্ত্রিসভা থেকে বের হয়ে আসব। সেই লক্ষ্যে প্রাথমিক প্রস্তুতিও ছিল। কিন্তু সেটা হবে বলে তো এখন মনে হচ্ছে না।’ এসময় তিনি সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও জাপার অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যার কথাও ব্যাখ্যা করেন। মন্ত্রিসভা থেকে জাপার বের হয়ে আসা না আসার বিষয়টি সর্বশেষ আলোচনায় আসে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সংসদে দলটির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের বক্তব্যকে ঘিরে। ওইদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতেই রওশন সংসদে বলেছিলেন, ‘আমরা সরকারি দল, না বিরোধী দল? এনিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা লাগে। আমাদের মন্ত্রীগুলোকে উইথড্র করে নেন। এটা যদি আপনি করেন, জাতীয় পার্টি (জাপা) বেঁচে যেত।’ রওশনের এই বক্তব্যের কয়েকদিন পর রংপুরে গিয়ে এরশাদ দুই দফায় স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘যেহেতু আমি নিজেও মন্ত্রী পদমর্যাদার, সেই কারণে আগে আমাকে পদত্যাগ করতে হবে, তারপর আমার দলের অন্য মন্ত্রীরা পদত্যাগ করবেন।’ পরের বাক্যে তিনি বলেছেন, ‘আমরা সবাই একসঙ্গেই পদত্যাগ করব।’ রওশনের বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় এরশাদের বক্তব্যের কারণে জাপার নেতা-কর্মীরা ভেবেছিলেন, ২৪ মার্চের জনসভায় এ নিয়ে এরশাদ আরও খোলাসা করে কিছু বলবেন। কিন্তু জনসভায় এরশাদ তার বক্তব্যে এই প্রসঙ্গেই যাননি, যাননি রওশনও। বরং এরশাদের নির্বাচনকালীন সরকারে থাকার কথায় উপস্থিত নেতা-কর্মীরা যা বোঝার তা বুঝেছেন।
 
এর আগে এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান  বলেছিলেন, ‘বিলম্বে হলেও বিরোধী দল যদি আত্মপরিচয় সংকটের বিষয়টি উপলব্ধি করে থাকে তাহলে সেটি ইতিবাচক। তবে এটা সত্যিকারের উপলব্ধি না-কি নতুন করে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার কৌশল তা দেখার বিষয়।’ ২৪ মার্চের জনসভায় এরশাদের বক্তব্যের পর ড. ইফতেখার আগের বক্তব্যই পুনরাবৃত্তি করে বলেছেন, ‘এটা নতুন করে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার কৌশল’। মিডিয়ার  সঙ্গে পৃথক আলাপচারিতায় দলটির নেতাদের মন্তব্য, গত চার বছর ধরেই তো জাপা মন্ত্রিসভা ছাড়ব-ছাড়ছি করছে, কিন্তু ছাড়েনি। বরং বারবার মন্ত্রিসভা থেকে বের হবার কথা বলে শেষ পর্যন্ত উল্টো আরও কয়েকজনকে মন্ত্রী করার অনুরোধ গেছে জাপার শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে।
 
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ১২ জানুয়ারি বর্তমান সরকার গঠন হওয়ার দিন থেকেই মন্ত্রিসভায় জাপার তিনজন সদস্য রয়েছেন। এরা হলেন-পরিবেশ ও বন মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা। এছাড়া পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবেও সরকারের প্রথমদিন থেকে রয়েছেন জাপা চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ। বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে রওশন এরশাদও পূর্ণমন্ত্রীর যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn