মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান-

১৯৪৭-এর পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা আমাদের জন্যে একটি প্রতারণা, একটি নতুন কলোনিতে পরিণত হওয়া ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সেটা বুঝতে বাঙালির মুহূর্তমাত্র বিলম্ব হয়নি। তাই ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলনের সূচনার মাধ্যমে বাঙালি জাতি-চেতনা অংকুরিত হয়ে মহীরুহ হবার পথে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৫২-তে জীবন দিয়ে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করে ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠা করার মধ্যেই আমরা অর্জন করি প্রথম সাফল্য।

আমরা যদি এই পূর্ববাংলার ভূখণ্ডের কথা চিন্তা করি তাহলে প্রথম থেকেই দেখতে পাব, কেউই আমাদের উপর শাসন চাপিয়ে স্থায়ী হতে পারেনি। সারা ভারতে আর্য শাসন স্থায়ীভাবে অধিকার বিস্তার করলেও পূর্ববঙ্গের স্বাধীনচেতা মানুষের কাছে বার বার প্রতিহত হয়েছে। নদী ভাঙন, বৈরী আবহাওয়া, জলমগ্নতা এই সমস্ত কিছুর সঙ্গেই লড়তে লড়তে আমাদের পূর্বপুরুষেরা হয়ে ওঠেন সংগ্রামশীল। সে সময় আর্যপীড়কদের বিরুদ্ধে যে কৌশলে আমাদের পূর্বপুরুষেরা লড়াই করেছেন, ১৯৭১ সালে আমরা তারই পুনরাবৃত্তি দেখেছি। আঘাত কর— সরে যাও— মিশে যাও— নিজের চেনা মানুষের ভিড়ে। ৭১-এর গেরিলা যুদ্ধের বীজ যেন লুকানো ছিল শতাব্দী ধরে আমাদের রক্তের ধারাবাহিকতায়।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ প্রচার করতে না দেওয়ায় বিপ্লবী ঢাকা বেতারের কর্মীরা বেতার বন্ধ করেছেন, ৮ই মার্চ সেই ভাষণ যা ধারণ করেছিলেন নাসার আহমেদ চৌধুরী নামে এক তদানীন্তন অনুষ্ঠান সংগঠক, তা প্রচার করতে দেবার শর্তে আবার বেতার কেন্দ্র খোলা হয়। প্রচারিত হয় সেই মহাকাব্যিক ভাষণ। সারা দেশের লোক সেটা শুনতে পান। জেগে ওঠেন সংগ্রামী চেতনায়। সারা দেশের মানুষ সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশনা দেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন শুরু করে। তাদের মধ্যে ঐ ভাষণে যে সংগ্রামী চেতনার জন্ম হয় তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি নিজে। ১৯৭১-এর ১৭ই মার্চ পরিবার নিয়ে রাজশাহী থেকে সিলেট রওয়ানা হই ট্রেনে। সিরাজগঞ্জ ঘাটে মালপত্রসহ স্টিমারে ওঠার পর জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে আবার স্টিমার থেকে ট্রেনে মালপত্র তোলার মতো টাকা আমার কাছে ছিল না। কিন্তু ঘাটের কুলিরা সব মালপত্র তুলে দিয়ে বলে ‘দেশ স্বাধীন না হইলে টেকা পয়সা দিয়া কী করব। দেশ স্বাধীন হউক তখন আইসা মিষ্টি খাওয়ায় যাইয়েন’। আমি বুঝতে পারি ভাষণটি বেতারে প্রচার হওয়ায় বঙ্গবন্ধুর সেই বজ্র কণ্ঠ সাধারণ মানুষকেও কতটা উজ্জীবিত করেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়ে গেছে তারা। ৯ মাসব্যাপী যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের মধ্যে তাদেরও কতজন আছেন কে জানে।

৫২-৭১ পর্যন্ত প্রতিটি গণআন্দোলনে প্রাণ দিতে হয়েছে এদেশের মানুষকে। চূড়ান্ত আত্মত্যাগের মাধ্যমে ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি আমরা। কিছু সুবিধাভোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও তাদের পরিচালনাকারী দেশদ্রোহীরা ছাড়া বাঙালি পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে সাধারণ জনগোষ্ঠীর এই লড়াই পৃথিবীর ইতিহাসে অদ্বিতীয়। যেমন অদ্বিতীয় বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণা। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ—আজ সেই ভাষণের বিশ্ব স্বীকৃতি আমাদের গৌরবকে করে তুলেছে আকাশচুম্বি। লেখক :সংগীত-ব্যক্তিত্ব

 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn