ফিরে দেখা ২০২০

করোনার কারণে বিশ্বজুড়েই বিষ ছড়িয়েছে ২০২০ সাল। সিলেটে সেই বিষকে আরও তেতো করেছে কিছু ঘটনা। এরমধ্যে একটি মুরারীচাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রাবাসে গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ। পুরো সিলেটকেই লজ্জায় ডুবিয়েছে এ ঘটনা।  এরআগে ২০১২ সালে ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষের জেরে এমসি কলেজের ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো। করোনা সংক্রমণের কারণে আর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো বন্ধ এমসি কলেজও। বন্ধ কলেজের ছাত্রাবাস। ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে ওই বন্ধ ছাত্রাবাসের একটি ঘটনায় আঁতকে ওঠে সবাই। ছাত্রাবাসে এক তরুণীকে ধরে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। তাও ওই তরুণীর স্বামীর সামনে। এই ঘটনায় অভিযুক্তদের সকলেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

সেদিন যা ঘটেছিলো

২৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে স্বামীকে নিয়ে শাহপরান মাজারে বেড়াতে গিয়েছিলেন নির্যাতনের শিকার তরুণী (২৫)। ফেরার সময় তারা গাড়ি থামিয়েছিলেন নগরের টিলাগড় এলাকার এমসি কলেজের প্রধান ফটকের সামনে। স্ত্রীকে প্রাইভেটকারে রেখে স্বামী পাশ্ববর্তী দোকানে গিয়েছিলেন। ওইসময় প্রাইভেটকারটি ঘিরে ধরে কয়েকজন তরুণ। প্রাইভেটকারসহ ওই দম্পতিকে তারা নিয়ে যায় বালুচর এলাকার এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের ভেতরে। সেখানে স্বামীর সামনেই গাড়ির ভেতর সংঘবদ্ধভাবে তরুণীকে ধর্ষণ করে ৬ তরুণ। পরে তাদের মারধর করে টাকা পয়সা ছিনিয়ে নেয় ধর্ষকরা। আটকে রাখে তাদের গাড়িও। রাত ১০টার দিকে খবর আসে এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে এই তরুণীকে নির্যাতন করেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এমন খবর শুনে ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। পুলিশ প্রথমে গিয়ে সময়ক্ষেপণ করে ও অভিযুক্তদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ ওঠে।


রাত সাড়ে ১১ টার দিকে পুলিশ ছাত্রাবাসে থেকে ওই তরুণীকে উদ্ধার করে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করে। তবে পালিয়ে যায় ধর্ষকরা।

দেশজুড়ে ক্ষোভ, মামলা

ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি ছাত্রাবাসে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়। এই ক্ষোভ পরদিন থেকে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। যা ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। এই ঘটনার পর ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনে জনমতের চাপ মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ধর্ষণবিরোধী আইনও সংশোধন করে সরকার। এদিকে, ঘটনার রাতেই নির্যাতিতার স্বামী বাদী হয়ে নগরের শাহপরান থানায় ৬ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন।  মামলায় আসামিরা হলেন- সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার উমেদনগরের রফিকুল ইসলামের ছেলে তারেকুল ইসলাম তারেক (২৮), হবিগঞ্জ সদরের বাগুনীপাড়ার মো. জাহাঙ্গীর মিয়ার ছেলে শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি (২৫), জকিগঞ্জের আটগ্রামের কানু লস্করের ছেলে অর্জুন লস্কর (২৫), দিরাই উপজেলার বড়নগদীপুর (জগদল) গ্রামের রবিউল ইসলাম (২৫) ও কানাইঘাটের গাছবাড়ি গ্রামের মাহফুজুর রহমান মাসুমকে (২৫)। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও তিনজনকে আসামি করা হয়। ঘটনার পর আসামিরা পালিয়ে গেলেও ৩ দিনের মধ্যে ৬ আসামিসহ সন্দেহভাজন আরও ২ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব ও পুলিশ। সন্দেহভাজন দুই গ্রেপ্তারকৃত হলেন- আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল ও মিসবাউল ইসলাম রাজন মিয়া। গ্রেপ্তারের পর তাদের প্রত্যেককে ৫ দিন করে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। রিমান্ড শেষে সকলেই দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।

এদিকে, গ্রেপ্তারের পর গত ১ অক্টোবর ও ৩ অক্টোবর ২ দিনে গ্রেপ্তার ৮ জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নমুনা সংগ্রহের পর পাঠানো হয় ঢাকার ল্যাবে। গত ৩০ নভেম্বর ধর্ষণের ঘটনার ডিএনএ প্রতিবেদন আদালতের মাধ্যমে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে এসে পৌঁছে। এরপর গত ৩ ডিসেম্বর সিলেটের মুখ্য মহানগর হাকিমের (সিএমএম) আবুল কাশেমের আদালতে ৮ জনকে অভিযুক্ত করে চাঞ্চল্যকর এই মামলার অভিযোগপত্র প্রদান করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য। অভিযোগপত্রে সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর, আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল ও মিসবাউল ইসলাম রাজন মিয়াকে সরাসরি ধর্ষণে সম্পৃক্ত এবং রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসুমকে ধর্ষণের সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই আটজনই বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন। অভিযুক্তদের প্রত্যকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত।

সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (গণমাধ্যম) বিএম আশরাফ তাহের বলেন, এমসি কলেজের ছাত্রবাসে ধর্ষণের ঘটনা দেশজুড়েই আলোড়ন তুলেছিলো। ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনায় পুলিশ দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই মামলার তদন্তকাজ শেষ করে অভিযোগপত্র প্রদান করে। এখন মামলার বিচার শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে।

কেমন আছেন সেই তরুণী

সে রাতের ঘটনার পর তিনদিন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ধর্ষণের শিকার সেই তরুণী। সেখান থেকে চলে যান তার বাবার বাড়িতে। এখনও বাবার বাড়িতেই আছেন তিনি। তার স্বামী ও ধর্ষণ মামলার বাদী জানিয়েছেন, তার স্ত্রী এখন শারিরীকভাবে সুস্থ আছেন। তবে মানসিকভাবে এখনও সে রাতের আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারেননি।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn