বিচার বিভাগের ‘কিছু অসঙ্গতি’র জন্য আইনজীবীরা দায়ী
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, আমাদের বিচার বিভাগের কিছু ইনকনসিস্ট্যান্স (অসঙ্গতি) আছে। এটার জন্য অনেকাংশে দায়ী আইনজীবীরা। আমরা বিচার করি। আপনাদের মতো বিজ্ঞ আইনজীবীরা আছেন যারা আইনের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। অনেকদিন ধরে খেয়াল করছি- আজকে এ ধরনের ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো খুব কম আইনজীবী পাই। যার পরিপ্রেক্ষিতে আইনের ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্ত বিচারকরা নিজেরা লেখাপড়া করে দিই। এতে ত্রুটি থেকে যায়।’
বুধবার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির শফিউর রহমান মিলনায়তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলএলএম ল’ইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ‘বাসন্তী উৎসব ও মনোজ্ঞ’ শীর্ষক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘রাষ্ট্র যদি মরালিটি (নৈতিকতা) বজায় না রাখে তাহলে সেই দেশে কোনোদিন শান্তি আসবে না। পৃথিবীতে শান্তি আসবে না। কোনো দেশের যদি কোনো প্রান্তে অশান্তি থাকে এটা কিন্তু ছড়িয়ে পড়বে পাশ্ববর্তী দেশে। তাই আইন প্রণয়ন করা, শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা, প্রত্যেক রাষ্ট্রকে এটা (নৈতিকতা) বহাল রাখতে হবে। বজায় রাখতে হবে। মেনে চলতে হবে।এরপরে বলতে হবে। আমি (রাষ্ট্র) আইন মানবো। আপনারা (জনগণ) আইন মানেন। আপনারা আইনে চলেন। আমি আইন মানবো না, আমি আইনে চলবো না। আর আমি যদি বলি আপনারা মানেন তাহলে সেই রাষ্ট্র কোনোমতে চলবে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘ইংল্যান্ডে লিখিত সংবিধান ছাড়া ডেমোক্রেসি (গণতন্ত্রের চর্চা) হচ্ছে, সরকার পরিবর্তিত হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শাসনতন্ত্রকে লোক দেখানো হিসাবে ব্যবহার করে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হলো। এরপরে একটা সমাজ জেগে উঠলো তারা হলো আপনাদের মতো আইনজীবী সমাজ। যারা বিখ্যাত আইন পেশার লোক তারা পৃথিবীর চিত্র পরিবর্তন করলেন। সেটা আমেরিকা থেকে শুরু হয়েছে। ৫/৬টা রায় হয়েছে নিগ্রোদের শিক্ষার অধিকার, বিভিন্ন অধিকার বিষয়ে। এটা (রায় দেওয়ার পক্ষে) কিন্তু শাসনতন্ত্রের বাইরে গিয়ে আইনজীবীরা তাদের প্রজ্ঞা দেখিয়ে, ব্যাখ্যা করে উপস্থাপন করেছেন এবং অ্যাক্টিভিস্ট জাজেস জন মার্শাল থেকে আরম্ভ করে, এরা এই করে আজকে একটা কল্যাণ রাষ্ট্র করেছেন। কিন্তু সেই কল্যাণকর রাষ্ট্র আজকে কি অকল্যাণকর কাজ হচ্ছে সেটার আমরা উপলব্ধি পাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘এখন এখানে দুইটা জিনিস। আইন এবং মোরালিটি। বিচারকরা অনেক সময় আইনটাকে পাশ কাটিয়ে মোরালিটির দিকে ধাবিত হই। আমরা কিন্তু মোরালিটির দিকে কোনোমতেই কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারি না।’
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, ‘যত খারাপ ঘটনাই ঘটুক আমরা বিচারকরা আইন যে কথা বলে সেই কথাই বলবো। এর মধ্যে এমন কিছু ঘটনা আছে যেগুলো মোরাল এথিকসের বাইরে। কিন্তু আইন এটাকে বেআইনি বলছে না। আমরা কিন্তু এটাই রায় দেবো। এই মোরালিটি যেটা, আমাদের এখানে আইন না, এটা কিন্তু হয়তো আমার পাশের দেশে একটা বেআইনি হতে পারে। সে দেশের যে বিচারক বিচার করবেন এবং আমার দেশের বিচারকের ব্যাখ্যার মধ্যে ব্যবধান থাকবেন। আমরা এটুকু ভুলে যাই।’
নিম্ন আদালতের জমি দখলের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোর্ট বন্ধকালীন সময় কোর্টের খালি জায়গায় রাতারাতি বিল্ডিং উঠে গেলো। প্রত্যেক জেলায় জেলায় এ অবস্থা। একটা জেলায় ২ একর কোর্টের জায়গায় বার (আইনজীবী সমিতি) দখল করে নিয়েছে। এই আইন পেশা যদি না থাকে, এই কোর্ট যদি না থাকে, তাহলে কি রকম হয়। আমি শুধু আপনাদের কাছে এই দায়িত্ব (জমি দখলের বিষয় বিবেচনা) দিয়ে দিলাম।’
আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা এগিয়ে আসবেন। কেন প্রধান বিচারপতি বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বলবে, এখানে আইনের শাসন হচ্ছে না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হচ্ছে না, বিচারকদের জন্য রুলস হচ্ছে না। সব কথা প্রধান বিচারপতি বলবে? আজ কোনো আইনজীবীকে গলা মিলিয়ে বলতে দেখলাম না। এটা ঠিক হচ্ছে না। আমি আশা রাখবো আপনারা আমার কথায় খুশি হননি। কোর্ট-কাচারি রক্ষা করতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কতদূর হলো এটা রক্ষা করতে হবে। আগে বার কাউন্সিল বেশ ভালো ভূমিকা নিয়েছিলো।’
‘কোর্ট কেবল আসামিদের জামিন আর দেওয়ানি মামলায় ইনজাকশন নিয়ে থাকলে পুরো জুডিশিয়ারি কোনোটাই টিকবে না। একদিন সব মিলিয়ে যাবে’ বলেও মন্তব্য প্রধান বিচারপতির।
সংগঠনের সভাপতি এ. কে. এম ফয়েজের সভাপতিত্বে এবং সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শেখ আলী আহমেদ খোকনের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, বিচারপতি এ কে এম আব্দুল হাকিম, বিচারপতি নাইমা হায়দার, বিচারপতি এম আর হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দিন খান, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক এস এম মুনীর প্রমুখ।