শেখ আদনান ফাহাদ-

বাঙালি এক থাকলে ১৯৪৭ সালেই ‘বাংলাদেশ’ নামে রাষ্ট্র হতে পারত। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৪৭ সালে কেন ধর্মের বাইরে গিয়ে বাঙালিদের আলাদা রাষ্ট্র হলো না তার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। বিশেষত কলকাতার হিন্দু এলিট শ্রেণি, দিল্লীর কংগ্রেস, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন লাহোর-করাচিকেন্দ্রিক মুসলিম লীগ এর সাম্প্রদায়িক অংশ এবং ইংরেজ প্রশাসকদের যোগসাজশে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের মাওলানা আকরাম খা, আবুল হাশিম, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং তরুণ রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবের স্বপ্নের ‘বাংলাদেশ’ আর তখন বাস্তবায়িত করা যায়নি। তবে এ প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় শেখ মুজিব ঠিকই বঙ্গবন্ধু হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন ১৯৭১ সালে।

কলকাতা, দার্জিলিং, আসামের কাছার, করিমগঞ্জ এবং তৎকালীন পূর্ব বাংলা নিয়ে গঠিত হওয়ার কথা ছিল অবিভক্ত ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র। কথা ছিল এই অবিভক্ত বাংলাদেশের মানুষ ঠিক করবে, তারা ভারতে যাবে নাকি পাকিস্তানে যাবে। ‘বাংলাদেশ’ নামে রাষ্ট্র না হলেও কলকাতা পূর্বপাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কারণ পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষের খাজনা-করের টাকায় গড়ে উঠেছিল কলকাতা। হিন্দু জমিদারদের বেশিরভাগেরই ঘর-বাড়ি ছিল কলকাতায়। কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর যৌথ ষড়যন্ত্রে কলকাতাকে পূর্ব-পাকিস্তানের অংশ হতে দেয়নি। জিন্নাহ এবং তার সহচররা বুঝে গিয়েছিল, কলকাতা পূর্বপাকিস্তানের সাথে থাকলে স্বভাবতই এটি হবে পাকিস্তানের প্রধান নগরী। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায় এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস এর চিন্তা ছিল, কলকাতা চলে গেলে তাদের আর থাকে কী? তাই মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশকে অন্ধকারে রেখে প্রতিক্রিয়াশীল অংশের নেতৃবৃন্দ দিল্লির এক গোপন সভায় ভারতের কাছে কলকাতাকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়। পূর্ববঙ্গের বাঙালির নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন হোঁচট খায় বাঙালিরই একটা অংশের স্বার্থপরতার জন্য। কারণ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কাছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ থেকে ‘ধর্ম’ প্রধান ইস্যু হয়ে উঠেছিল। ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগ হয়ে যাওয়ার খেসারত দিতে হয়েছিল বাঙালি হিন্দু-মুসলমান সবাইকেই।

খেসারত কি এখনো দিতে হচ্ছে না? শুধু বাংলা ভাগের মধ্যেই বাঙালির অনৈক্য প্রকাশ পেয়েছে তা নয়। ভারতের বাঙালি আর বাংলাদেশের বাঙালি যে দরকারের সময় একমত হতে পারে না, তার বড় নজির তিস্তার পানি চুক্তি। বাঙালি বলে বলে ঢাকা ও কলকাতার শিল্পী, রাজনীতিবিদদের একটা অংশ কখনো কখনো অতি আবেগের প্রকাশ ঘটালেও বাংলাদেশের একটা বড় অঞ্চলের মানুষের জীবন মরণের বিষয় তিস্তার পানি ইস্যুতে কাউকে সোচ্চার ভূমিকা রাখতে দেখা যায় না। দিল্লি বলে মমতার কথা। মমতা বলেন জল নাই, কোত্থেকে দেব?

একটা তারিখ কিংবা একটা মাসের কি ভিন্ন ভিন্ন হিসেব থাকতে পারে? ইংরেজি ক্যালেন্ডারে তো এ সমস্যা নাই। সূর্যের উদয়-অস্তের ঘেরাটোপে পরে একেক রাষ্ট্রে এক দিন হতে পারে। কিন্তু নির্দিষ্ট একটা দেশে ইংরেজি দিন-ক্ষণের কোনো হেরফের হয় না। আমরা তো একসময় এক সাথেই ছিলাম। আমাদের মধ্যে মাত্র ত্রিশ মিনিটের ব্যবধান। প্রায় একই সাথে সূর্য উঠে, আবার একই সাথে সূর্য অস্ত যায়। তাহলে কেন ভিন্ন ভিন্ন তারিখে বাংলাদেশি বাঙালি আর ভারতীয় বাঙালিরা পহেলা বৈশাখ পালন করে?

বাংলাদেশের বাঙালিরা খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে আর ভারতীয় বাঙালিরা পালন করে কখনো ১৫ এপ্রিল, কখনো ১৪ এপ্রিল, অর্থাৎ পঞ্জিকা হিসেব করে যা আসে। অধিকাংশ গবেষকের মতে, বাংলা সনের প্রবর্তক মুঘল সম্রাট জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর। খাজনা সংগ্রহ করা হত চান্দ্র-হিসেব ভিত্তিক হিজরি তারিখ মোতাবেক। কিন্তু বাংলার কৃষকরা মেনে চলত সূর্যের হিসেবের দিনক্ষণ। ফলে খাজনা প্রদানের এবং আদায়ের প্রক্রিয়ায় সমস্যা হতো। এই সমস্যা দূর করতেই সম্রাট আকবর চালু করলেন সূর্য-হিসেব ভিত্তিক বাংলা সন।  ফলে বাংলা সন হল হিজরি চান্দ্র সনের সৌররূপ। এ সনের মাস কোন নির্দিষ্ট ঋতুর সাথে বজায় থাকে না। চান্দ্রসনের বছর ৩৫৪ দিনে আর সৌর সনের বছর ৩৬৫ দিনে হয়। চান্দ্র সনের বছরে চাষকার্যে চাষিরা আগের বছর যে তারিখে ফসল কেটেছিল তা পরের বছর ১১ দিন এগিয়ে যায়। ফলে ফসল কাটার অসুবিধা হতো। যার পরিণতিতে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিত। ফলে সূচনা হয় বাংলা বর্ষপঞ্জীর।

জনপ্রিয় ব্লগ সচলায়তন এ ষষ্ঠ পাণ্ডব নামের একজন লেখকের লেখা থেকে জানা যায়, ‘সূর্যের পরিক্রমণের সাথে বাংলা সনের এই ক্যালেন্ডারটি যথাযথভাবে সমন্বিত না থাকায় সেটি সংশোধনের প্রয়োজন পড়ে। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমির তরফ থেকে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ এটি সংশোধন করেন। সংশোধনীতে বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত প্রতি মাস ৩১ দিনে, আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত প্রতি মাস ৩০ দিনে এবং অধিবর্ষে ফাল্গুন মাস ৩১ দিনে হিসেব করার প্রস্তাব করা হয়। ১৯৮৭ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এই ক্যালেন্ডার গ্রহণ করে। পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য বাংলা একাডেমি’র ক্যালেন্ডার অনুসৃত হয় না। সেখানে একাধিক প্রকার ক্যালেন্ডার চালু আছে যেখানে মাসে দিনের সংখ্যা ২৯ দিন থেকে ৩২ দিন পর্যন্ত হয়। একই মাস বিভিন্ন ক্যালেন্ডার বিভিন্ন দৈর্ঘ্যে হিসেব করা হয়’।

বোঝা যাচ্ছে, পুরনো পঞ্জিকা মেনে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ তালাশ করতে সমস্যা হচ্ছিল বিধায় এরশাদ আমলে ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত সমাধানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করা হয়। নির্ধারিত হয় যে ১৪ এপ্রিল, প্রতি বছর বাঙালিরা পহেলা বৈশাখ উদযাপন করবে। বাংলাদেশের বাঙালিরা এ তারিখটিতে মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ নানা রঙে পালন করলেও ভারতের বাঙালিরা ভিন্ন দিনে আয়োজন করে। যদিও ঢাকার মানুষের সংখ্যা, বর্ণিল  আয়োজন এবং উদযাপনের বিশালত্ব বিবেচনায় কলকাতায় বা ত্রিপুরার উদযাপন তুলনীয় নয়। কলকাতা কেবল মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু করল। চার বছর পর পর লিপ ইয়ার আসলে পশ্চিমবঙ্গেও ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ কোনো কোনো বছর পালন করতে হয়। তার মানে পঞ্জিকা সবসময় অনুসরণযোগ্য নয়। একেক বছর একেক তারিখে পালন করলে সেটা বৈজ্ঞানিক হয় না। ফলে বাংলা একাডেমির অনুরোধে মহাপণ্ডিত শহীদুল্লাহ যে সমাধান দিয়েছিলেন, সেটাই সকলের অনুসরণ করা উচিত। অন্তত বাংলাদেশের সকলের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, এদেশের কিছু মানুষও ১৫ এপ্রিল এবার পহেলা বৈশাখ পালন করেছে। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। এমনিতেই বাংলাদেশে সমস্যা অনেক। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কমমাত্রায় হলেও নানা বিষয়ে সমস্যা আছে। রাষ্ট্রের চরিত্র সেক্যুলার হলেও, হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই সমস্যা আছে। আবার মুসলমানদের মধ্যে অনেক ধারা। কওমি মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা, জেনারেল স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে রাজনৈতিক এবং মানসিক সমস্যা আছে। সম্ভাবনাময় কিন্তু কখনো নীরব, কখনো সরব সমস্যাপূর্ণ এই সমাজে একটা পহেলা বৈশাখ একটা অন্যরকম আবহ নিয়ে আসে। এই একটি দিন সবাই না হোক, সমাজের বড় একটা অংশ নিজেকে বাঙালি পরিচয়কে প্রধান করে রাস্তায় নামে। এর মধ্যে আমাদের কেউ যদি কলকাতার সাথে মিলিয়ে পহেলা বৈশাখ ভিন্ন দিনে পালন করে তাহলে একে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা বলা ছাড়া আর কী বলা যায়?

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn