মানুষের ভেতর বর্বরতা আর উদারতা দুটোই পাশাপাশি বাস করে। কেউ বর্বরতাকে নিভিয়ে রাখে, কেউ উদারতাকে নিভিয়ে রাখে। কী করে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে মেরেছে অভিজিৎকে, কী করে অনন্ত বিজয়কে, ওয়াশিকুর বাবুকে, দেখিনি। কিন্তু ইন্টারনেটে রাজস্থানের শম্ভুলাল রেগর কী করে আফরাজুলকে কুপিয়ে মেরেছে, তা শম্ভুলাল আর তার ভাইপো’র কল্যাণেই দেখা হয়েছে। তারা হত্যাদৃশ্য ভিডিও করে ইন্টারনেটে প্রচার করেছিল। ঠিক যেমন আইসিস করতো। ধারালো ছুরিতে নিরীহ মানুষদের গলা কেটে হত্যা করতো, আর হত্যার ভিডিও গোটা জগতকে দেখাতো। আইসিস জানতো, সিরিয়ার যে এলাকা তাদের দখলে সেখানে তাদের গ্রেফতার করার জন্য কোনও পুলিশ আসবে না। শম্ভুলালও সম্ভবত ভেবেছিল তারও শাস্তি হবে না!
শম্ভুলালের কোনও মানসিক সমস্যা নেই। খুব ঠাণ্ডা মাথায় সে আফরাজুলকে কুপিয়েছে। আফরাজুলের দোষ কী ছিল? পশ্চিমবঙ্গের গরিব গ্রামের গরিব লোক সে। ওই গরিব গ্রামের অনেক গরিব লোকই রাজস্থানে এবং আরও অন্য রাজ্যে দিনমজুরি করতে যায়। আফরাজুল প্রায় ৫০ বছর বয়সী, কোনও হিন্দু মেয়েকে সে ভালোবাসার অভিনয় করে বিয়ে করছে না, তাকে ধর্মান্তরিতও করছে না। শম্ভুলালের বন্ধুরা বলেছে, একটি হিন্দু মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতো শম্ভুলাল, ওদিকে আবার এক মুসলিম লোকের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিল মেয়েটির। তবে সেই মুসলিম লোকটি আফরাজুল নয়। শম্ভুলালের সেই প্রেমিকা একদিন তার মুসলিম প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যায়। তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেই একবার পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিল শম্ভুলাল। সেই সময় কয়েকজন বাঙালি মুসলমান শ্রমিকের হাতে মার খেয়েছিল সে। শুধু ওই মেয়েটিই নয়, আরও রাজস্থানী হিন্দু মেয়ে শম্ভুলালের গ্রাম থেকে পালিয়ে গিয়ে মুসলমান লোককে বিয়ে করেছে। অনেকে ধারণা করছে, শম্ভুলাল তাই হাতের কাছে যে মুসলমানকে পেয়েছে, তাকেই হত্যা করে   মুসলমান-পুরুষদের ভয় দেখিয়েছে যে ফের কেউ কোনও হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত করার মতলব আঁটছো তো পরিণতি আফরাজুলের মতোই হবে। তার মানে শম্ভুলালের হাতে মরতে হবে তাদের। প্রশ্ন হলো, এত সাহস, আইসিসের মতো সাহস, শম্ভুলাল অর্জন করলো কী করে? তাহলে কি শম্ভুলালের মুসলিম বিরোধিতাকে সমর্থন করার লোক আরও আছে, এবং শম্ভুলাল জানে যে সে ধিকৃত না হয়ে বরং সম্মানিত হবে, সকলে তার সাহসের প্রশংসা করবে?  

টুইটারে যখন শম্ভুলালের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নিন্দে করেছি, অবাক হয়ে লক্ষ করেছি, প্রচুর লোক শম্ভুলালের এই হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করছে। আগেও গোরক্ষকরা যখন নিরীহ মুসলমানদের পিটিয়ে মেরেছে, তার নিন্দে করলেও প্রচুর হিন্দু রাগ করেছে। ভারতে বাস করে ভারতের হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে কোনও শব্দ যেন উচ্চারণ না করি হুমকি দিয়েছে। হিন্দুদের কাজকর্ম, তাদের ধর্ম সংস্কৃতি ভালো না লাগলে আমি যেন ভারত থেকে বেরিয়ে যাই। অসহিষ্ণুতা এখন চরমে। আগেও তো হিন্দু ধর্মের অবিজ্ঞান আর নারী-বিরোধিতা নিয়ে সমালোচনা করেছি, এমন হুমকি তো পাইনি। আমার কাছে চিরকালই যে কোনও ধর্মের চেয়ে বড় মানবাধিকার, মনুষত্ব আর মানবতা, বৈষম্যহীনতা, আর সমতা। আমি কোনও একটি ধর্মের সমালোচনা করেছি, এর মানে কিন্তু এই নয় যে আমি এই ধর্মটি ছাড়া অন্য ধর্মগুলোকে পছন্দ করি।

ভারতবর্ষে ধর্মের আস্ফালন যত বাড়ছে, তত বাড়ছে বিধর্মীদের প্রতি ঘৃণা, ঘটা করে পালন হচ্ছে নারী-বিরোধী উৎসব। এ কারণেই পদ্মাবতীর মুক্তি ঠেকিয়ে দেওয়া যায়। এ কারণেই গোমাংস খেয়েছে এই অভিযোগে মুসলমানদের যারা হত্যা করেছে, তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াতে পারছে। এ কারণেই যারা গৌরী লংকেশ বা কালবুর্গিকে খুন করেছে, তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। ভারতবর্ষের এই পরিবর্তন মেনে নিতে ইচ্ছে করে না। আশা করি এই পরিবর্তন ক্ষণস্থায়ী।

শম্ভুলাল রেগরের মুসলিম হত্যা এবং এর ভিডিও ইন্টারনেটে দম্ভের সঙ্গে প্রচার করা নিয়ে টেলিভিশনের জনপ্রিয় চ্যানেলগুলো বা বড় বড় পত্রিকাগুলো বড় খবর করেনি। যেন এটি প্রতিদিনকার আটপৌরে হত্যার মতোই হত্যা। এটি কিন্তু তা নয়, কারণ এটির ভিডিও প্রচার করা হয়েছে। আইসিসের খুনি সদস্যরা নিজেদের  মুখ ঢেকে মানুষ হত্যা করতো। শম্ভুলাল মুখও ঢাকেনি। মুসলমানদের যে খুব সহজে মেরে ফেলা যায় তা-ই দেখানো হয়েছে ভিডিওতে। মুসলমানদের মেরে ফেলা যায়, কারণ মুসলমানরা ভারতবর্ষ দখল করেছিল, হাজারও মন্দির ভেঙেছিল, হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল, হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করেছিল, হিন্দুদের দেশে হিন্দুদের শাসক বনে হিন্দুদের কাছ থেকেই কর নিয়েছিল। এখন শুরু হয়েছে ‘লাভ জিহাদ’। প্রেমের অভিনয় করে মুসলমান পুরুষেরা হিন্দু মেয়েদের বিয়ে করছে ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশে। এই ‘লাভ জিহাদ’ ঠেকাতে চায় শম্ভুলাল। হিন্দু মেয়েদের কিছুতেই সে মুসলমান হতে দেবে না। লাভ জিহাদের বিপরীতে হিন্দুরাও ‘ঘর ওয়াপসি’ করছে, মুসলমানেরা যেন ইসলাম ত্যাগ করে তাদের পূর্বপুরুষের হিন্দু ধর্মকে বরণ করে নেয়। ঘর ওয়াপসি, লাভ জিহাদ দুটোই মন্দ। কিন্তু  হিন্দু-মুসলমানের  সত্যিকার প্রেমকে অস্বীকার করা, অপদস্থ করা উচিত নয়।      

যাই হোক, প্রশ্ন হলো, মুসলমানরা যে ভুল অতীতে করেছিল, তার দায় কেন আফরাজুলকে নিতে হবে? ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরে হিন্দু মৌলবাদিরা ভারতের বাবরি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর বাংলাদেশের মুসলমান মৌলবাদিরা বাংলাদেশের হিন্দুদের মন্দির পুড়িয়ে দিয়ে শোধ নিয়েছিল। ভারতের হিন্দু মৌলবাদিদের অপকর্মের দায় বাংলাদেশের নিরপরাধ হিন্দুদের নিতে হবে কেন? যারা মনে করে বাবরি মসজিদ ভাঙার দায় বাংলাদেশের হিন্দুদের নয়, তারা কি সবাই মনে করছে মুসলমান শাসকদের বা লাভ জিহাদিদের অপকর্মের দায় আফরাজুলের মতো নিরপরাধ শ্রমিকের নয়? যদি মনে করে থাকে দায়টা আফরাজুলের, তাহলে তারা বিভাজনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করছে। এই রাজনীতি ভারত ভাগ করেছে একবার, এই রাজনীতি ভারত ভাগ করবে আবার।  

শম্ভুলালের  সমর্থক সংখ্যা প্রচুর। হিন্দুরাও চাইলে সন্ত্রাসী হয়ে উঠতে পারে, তার প্রমাণ তারা রেখেছে।  এখন রাষ্ট্রকে কিছুটা অনুকূলে পেলে সন্ত্রাসী কাজকর্ম নির্ভাবনায় চালিয়ে যেতে পারে। শম্ভুলাল জেলে, কিন্তু হাজারো শম্ভুলাল জেলের বাইরে শম্ভুলালের মতোই একই রকম রাগ, ঘৃণা, আর বিদ্বেষ পুষছে। ঠিক ক’জনকে জেলে ভরে শান্তি আনা যায়? ঠিক ক’জন গরিব মুসলমানকে ভয় পাওয়া থেকে, কুণ্ঠিত হয়ে থাকা থেকে বাঁচানো যাবে! রাজস্থানে আফরাজুলের মতো আরও বাঙালি মুসলমান শ্রমিক কাজ করে, তারা এখন রাজস্থানে ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছে। ভাবছে তাদের অবস্থাও যদি আফরাজুলের মতো হয়! হিন্দু মুসলমানের এই হিংসে এই ঘৃণা দেখতে ভালো লাগে না। সবাই আমরা ভারতীয়, সবাই আমরা দক্ষিণ এশীয়, সবাই আমরা একই গ্রহের মানুষ, সহমর্মিতা ছাড়া আমাদের বাঁচার উপায় নেই। ধর্ম আমাদের পরিচয় নয়, জাতি আমাদের পরিচয় নয়, ভাষা বা বর্ণ আমাদের পরিচয় নয়, প্রাচুর্য আমাদের পরিচয় নয়। আমাদের পরিচয় আমরা কতটুকু উদার, কতটুকু সহিষ্ণু, কতটা মানুষ।   

লেখক: কলামিস্ট

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn