তসলিমা নাসরিন- আমি পুজো উদবোধন করেছি বলে কিছু ধর্মান্ধ মুসলিম চেঁচাচ্ছে, বলছে আমি হিন্দু, আমি নাস্তিক নই। ভাবটা এমন, যেন নাস্তিক হলে তাদের খুশির অন্ত ছিল না, যেন হিন্দু না হয়ে নাস্তিক হলে তারা আমাকে খুব ভালবাসতো, যেন নাস্তিকদের তারা ঘৃণা কিছু কম করে, যেন নাস্তিকদের তারা নির্বিচারে কুপিয়ে মারেনি!!

যত ধর্ম এ পর্যন্ত পয়দা হয়েছে, সব ধর্মই গাল গপ্প, রূপকথা। হিন্দুরা জানে মুসলমান পরিবারে জন্ম নেওয়া আমি একজন নাস্তিক। হিন্দুরা জানে আমি হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করি না, হিন্দুরা জানে আমি আর সব ধর্মের মতো হিন্দু ধর্মেরও সমালোচক, আমি তাদের কুসংস্কারের নিন্দে করি,  তারপরও হিন্দুরা আমাকে তাদের আনন্দমেলার বিচারক হওয়ার জন্য ডাকে,  তাদের সর্বজনীন পূজা উদবোধন করার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানায়, পূজা কমিটির পক্ষ থেকে আমাকে সম্বর্ধনা দেয়।

মুসলমানরা আমি কট্টর নাস্তিক জানার পর, আমি ইসলামের সমালোচনা করি জানার পর, আমাকে দিয়ে কি কোনও  মাদ্রাসা বা মসজিদ উদবোধন করাবে? আমাকে কি ঈদগা মাঠে ভাষণ দিতে দেবে? আমাকে কি কোনও  ঈদ উৎযাপন কমিটি সম্বর্ধনা দেবে?  দিলে আমি সানন্দে তা গ্রহণ করবো। ঠিক যেমন হিন্দুদের দেওয়া সম্বর্ধনা আমি সানন্দে  গ্রহণ করি।

আমি ধর্মে বিশ্বাস করি না, কিন্তু আমি মানুষে বিশ্বাস করি। মানুষের ওপর ধর্মের নামে কোনও নির্যাতন হলে আমি সেই মানুষের পাশে, সে যে ধর্মেরই হোক না কেন, দাঁড়াই। আমি  মানুষের উৎসবে বিশ্বাস করি, অন্যের ক্ষতি না করে তারা যদি ধর্ম পালন করতে চায়, তাদের সেই ধর্ম পালনের অধিকারের জন্য আমি লড়ি।  আমি বিশ্বময়   আর্ট কালচারের মিউজিয়াম যেমন দেখি,  ধর্মীয় উপাসনালয়ও দেখি,   সেসবের ইতিহাস আর   শিল্প  স্থাপত্য আমি উপভোগ করি। একই সঙ্গে  মানুষকে মুক্তচিন্তা  এবং বিজ্ঞানমনস্কতায় উৎসাহ দিতে আমি হেন উদ্যোগ নেই যে নিই না,  আজ চার দশক ধরে গ্রন্থের পর গ্রন্থ লিখে চলেছি।

স্পেনের আন্দালুসিয়ায় আমি গিয়েছি শুধু মুসলমানদের স্থাপত্য দেখার জন্য, ধর্ম কোনও   স্থাপত্য   তৈরি করে না, স্থপতী  তৈরি করে স্থাপত্য। স্থপতীর  প্রতিভা  আমাকে মুগ্ধ করে। আমি   ইউরোপের মিউজিয়ামগুলোয়  শিল্পী রাফায়েল, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মিকেলেঞ্জলো, পল গগাঁ, র‍্যামব্রান্টের আঁকা ক্রিশ্চান ধর্মের গল্প  উপলক্ষ্যে  যে ছবি এঁকেছেন, যে ভাস্কর্য গড়েছেন,  দেখতে গিয়েছি, ভ্যাটিক্যানে সিস্টিন চ্যাপেলের আর্ট দেখতে গিয়েছি, গ্রীসের অলিম্পিয়া পাহাড়ের দেব দেবীর ভাস্কর্য দেখতে গিয়েছি মিউজিয়ামে, প্রাচীন রোমান দেব দেবী্র ভাস্কর্য  দেখতেও মিউজিয়ামে মিউজিয়ামে ঘুরেছি।  কেরালার কচিতে গিয়েছি  শুধু ব্যাবিলনীয় ইহুদিদের প্রাচীন সিনেগগ দেখতে। উড়িষ্যার কোনার্কে গিয়েছি, মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহে গিয়েছি মন্দিরের শিল্প  দেখতে।

যারা একেবারেই সহ্য করতে পারছে না  আমার পুজো বা শারদীয় উৎসবের উদবোধন করার ব্যাপারটি, তারা যদি চায় আমি মুসলমানের উৎসব উদবোধন করি, করবো, করে আমি তো ভীষণই আনন্দ পাবো।    আমি তো চাই টংগীর বিশ্ব ইজতেমা   ফিতে কেটে উদবোধন করতে,  দেওবন্দের অনুষ্ঠান গুলোয়  প্রধান অতিথি হতে,  ওয়াজ মাহফিলগুলো   প্রদীপ জ্বেলে  শুরু করতে।  হিন্দুর উৎসবে যেমন হিন্দুরাই আমার নিরাপত্তা হয়ে ওঠে, ইজতেমায় বা দেওবন্দে বা ওয়াজ মাহফিলে মুসলমানরাই আমার নিরাপত্তা হবেন, আমি তো চাই। আমি তো চাই মুসলমানরা সভ্য হোক, অসাম্প্রদায়িক হোক, উদার হোক। হতে পারবে?   আমার গায়ে একটি টোকা পড়বে না, কেউ কোনও গালি দেবে না, কেউ অশ্লীলতা করবে না– এমন  সভ্য একটি পরিবেশ চাই, পারবেন দিতে? আপনারা  রাজি হলে আমি এক পায়ে খাড়া।  

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn