ম্যানহাটনে টাইম স্কয়ার সাবওয়ে স্টেশন থেকে বাস স্টেশনে যাতায়াতের ভূগর্ভস্থ পথে বোমা হামলার ঘটনায় বন্ধ হতে পারে পারিবারিক চেইন অভিবাসন প্রক্রিয়া। এই ঘটনা পরবর্তিতে এমনই ইঙ্গিত দিয়েছে হোয়াইট হাউজ। এই হামলার ঘটনায় আটক করা হয়েছে বাংলাদেশের নাগরিক আকায়েদ উল্লাহকে। বোমা বিস্ফোরণে সে নিজেই গুরুতর আহত হয়েছে। জানা গেছে, ২৭ বছরের বয়সের আকায়েদ উল্লাহ ২০১১ সালে নিউইয়র্কে আসেন। পারিবারিক অভিবাসনে আমেরিকায় তাঁর আগমন ঘটে। পরিবারের সঙ্গে ব্রুকলিনে থাকেন আকায়েদ উল্লাহ। তাঁর বাড়ি থেকে গতকালই একজনকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে পুলিশ। তবে আকায়েদ উল্লাহকে চেনেন—এমন কাউকে এখনো পাওয়া যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা ও তদন্তকারী সংস্থাগুলো এখন এই সন্দেহভাজন হামলাকারীর বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানো হয়েছে। বিবৃতিতে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থানের কথা বলা হয়েছে। আকায়েদ উল্লাহর দেশের বাড়ি সন্দ্বীপের মুছাপুরে। বাবা সানাউল্লাহ মিয়া। যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে তিনি ঢাকার হাজারীবাগ এলাকায় থাকতেন বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাঙালিদের মতে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অভিবাসনবিরোধী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্রুতই পরিস্থিতিকে তাঁর অনুকূলে ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছেন। হোয়াইট হাউস থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিবাসননীতি বাস্তবায়ন হলে আকায়েদ উল্লাহর মতো অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সুযোগ পেত না।

সম্প্রতি ম্যানহাটনে উজবেকিস্তান থেকে আসা এমন এক অভিবাসীর বেপরোয়া গাড়ি হামলায় আটজন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এমনিতেই পারিবারিক অভিবাসন বন্ধের বিষয়ে সোচ্চার মার্কিন প্রেসিডেন্ট। অভিবাসীদের দ্বারা একই ধরনের দুটি হামলার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন আরও জোর গলায় বলছেন, চেইন ইমিগ্রেশন বন্ধ করতে হবে। আকায়েদ উল্লাহ গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র সারাহ হাকাবি সেনডার্স বলেছেন, পোর্ট অথোরিটি বাস টার্মিনালে হামলার ঘটনা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন সংস্কারের আহ্বানের যথার্থতা প্রমাণ করে। পারিবারিক অভিবাসনের বদলে মেরিট বা যোগ্যতা অনুযায়ী অভিবাসন প্রদানের যে আহ্বান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করছেন, এ নিয়ে কংগ্রেসকে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে। অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশনও দ্রুত একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মাত্র দুই মাসের মধ্যে নিউইয়র্কে দুটি জঙ্গি হামলার জন্য আমাদের ব্যর্থ ইমিগ্রেশন আইন দায়ী।’

লটারি ভিসা বা পারিবারিক ভিসায় আসা অভিবাসনে আমেরিকার কোনো স্বার্থ সংরক্ষিত হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমেরিকার একজন নাগরিকের বোনের ২০ বছরের এক ছেলের পারিবারিক অভিবাসনে আমেরিকার কোনো স্বার্থ জড়িত নেই। এ ছাড়া যদি প্রতিভার ভিত্তিতে যাচাই বাছাই করে অভিবাসন দেওয়া যায়, তাহলে আমেরিকা উপকৃত হবে এবং নিরাপত্তাও অক্ষুণ্ন থাকবে। নিউজার্সি থেকে নির্বাচিত সিনেটর ডেমোক্র্যাট কোরি বুকার অবশ্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চেইন অভিবাসন বন্ধের উদ্যোগের বিরোধিতা করে বিবৃতি প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন, নিরাপত্তার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অগ্রাধিকারের বিষয়টি স্থির না করে এদিক-ওদিক বক্তব্য রাখছেন। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান মতে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি দুজন নতুন অভিবাসী গড়ে সাতজন বিদেশি আত্মীয়কে আমেরিকায় নিয়ে আসেন।‘চেইন মাইগ্রেশন’ হলো আমেরিকায় বৈধ অভিবাসনের বৃহত্তম প্রক্রিয়া। প্রতি দুজন অভিবাসী সাতজন করে আত্মীয়কে আমেরিকাতে আনেন, যা আমেরিকার চলমান অভিবাসন ব্যবস্থায় ৭০ শতাংশেরও বেশি। লাগাতার চেইন মাইগ্রেশনে ২০০৫ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ৯৩ লাখ বিদেশি নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন। একই সময়ে বিদেশি নাগরিক বৈধ অভিবাসনের অধীনে ১ কোটি ৩৬ লাখ বিদেশি নাগরিক আমেরিকায় প্রবেশ করেন।

বর্তমানে প্রতি ১৫ জনের মধ্যে মাত্র একজন বিদেশি নাগরিক দক্ষতা ও চাকরি নিয়ে আমেরিকায় আসেন। গত দশকে ১৭ লাখ মেক্সিকান নাগরিক চেইন মাইগ্রেশনের অধীনে আমেরিকাতে আসেন। প্রত্যেক মেক্সিকোর অভিবাসী মোটামুটি ছয়জন বিদেশি আত্মীয়কে আমেরিকায় আনেন। মেক্সিকো অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি চেইন মাইগ্রেন্টদের যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায়। চেইন ইমিগ্রেশন বা পারিবারিক অভিবাসনে গত চার দশকে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বেশি অভিবাসন ঘটেছে আমেরিকায়। সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও, ডি ভি লটারি বা অন্যান্য ভিসায়, এমনকি রাজনৈতিক আশ্রয়ে অভিবাসন পাওয়া বাংলাদেশিরা পারিবারিক ভিসায় স্বজনদের ব্যাপকভাবে আমেরিকায় অভিবাসন করিয়েছেন। ভারত বা উপমহাদেশের অন্যান্য দেশ থেকে এইচ ওয়ান ভিসায় বাংলাদেশ থেকে খুব বেশি অভিবাসন ঘটেনি আমেরিকায়। বাংলাদেশিদের কয়েক লাখ অভিবাসনের আবেদন এ চেইন ইমিগ্রেশনের আওতায় লাইনে আছে বলে ধারণা করা যেতে পারে। আমেরিকায় বাংলাদেশিরা অনেকটাই দ্বৈত জীবন যাপন করেন। সুনামের সঙ্গে কাজ কর্ম করে আমেরিকার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন বাংলাদেশিরা। অল্প ব্যতিক্রম ছাড়া মূলধারার সমাজে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো উদ্যোগ তাদের নাই। কীভাবে এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যায়, এ নিয়ে কারও কোনো স্বচ্ছ ধারণা নেই।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, এই ঘটনা বিষয়ে নীরব থাকা বা ঘটনাকে অস্বীকার করা কৌশল হতে পারে না। এমন কৌশল সুদূরপ্রসারী ভাবে কাজ দেবে না। তিনি বলেন, কাউকে অভিযুক্ত না করে বাংলাদেশি অভিবাসী সমাজেই কোনো সমস্যা আছে কিনা চিহ্নিত করার একটা সুযোগ হিসেবে নিতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় ব্যক্তি বিশেষের জঙ্গিবাদে ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কা প্রতিরোধে পারিবারিক, সামাজিক উদ্যোগে আন্তরিক হতে হবে। তিনি বলেন, আমেরিকায় বাংলাদেশিরা মূল ধারায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও সমাজের এক অংশ অন্য নাগরিক গোষ্ঠী থেকে এক ধরনের আলাদা জীবন যাপন করছেন। নিজেদের কমিউনিটি জীবনের বাইরে আমেরিকার মূলধারার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা শুধু সংকটই নয়, অনেক সম্ভাবনারও অন্তরায় বলে তিনি মনে করেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn