সরাফ আহমেদ : ওয়ারশতে আয়োজিত গ্রীষ্মকালীন বাংলা স্কুলে ইউরোপের নানা দেশের অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা ওয়ারশতে আয়োজিত গ্রীষ্মকালীন বাংলা স্কুলে ইউরোপের নানা দেশের অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা ইউরোপে নানা মাধ্যমে শুরু হয়েছে বাংলা ভাষার চর্চা। তেমনই একটি উদ্যোগের গল্প ইউরোপের ভরা গ্রীষ্মে দুই সপ্তাহজুড়ে বাংলা ভাষা ক্যাম্প। অবাক লাগে, এই সময়টাতে এখানকার বেশির ভাগ মানুষ ছুটি কাটাতে সাগরমুখী হয়। আর সেই ছুটি কাটানোর আনন্দ পেছনে ফেলে বাংলা ভাষা ক্যাম্পে যোগ দিতে তাঁরা জার্মানি থেকে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ গিয়েছিলেন। 

অবাক হয়ে দীর্ঘদিনের বন্ধুসম জিগফ্রিড স্মিড আর বের্নহার্ড হের্টলাইনের কাছে সেই ভাষা ক্যাম্পের গল্প শুনি। তাঁরা দুজনই দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশকে নিয়ে নানা কাজ করছেন। কিছুদিন আগে জানালেন, তাঁরা বাংলা ভাষা শেখার জন্য পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ যাচ্ছেন। শুধু জার্মান থেকেই নয়, সেই ভাষা ক্যাম্পে যোগ দেবেন ইউরোপের নানা দেশের বাংলা ভাষাপ্রেমীরা। উৎসাহী হয়ে জিজ্ঞাসা করি, হঠাৎ করে এই উৎসাহ, তাগাদা তাঁরা কোথায় পেলেন! দুজনেই বললেন, বাংলাদেশকে চেনেন বহুদিন ধরে, তবে বাংলা ভাষা শিখে বাংলাদেশের মাটি, মানুষ আর সংস্কৃতিকে চেনার মধ্যে অন্য এক আবেগ রয়েছে।

বাংলা ভাষা শেখার এই কাজে সহায়তা করছেন মধ্য ইউরোপের তিনটি নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়। জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাগের চার্লস বিশ্ববিদ্যালয় এবং ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ইনস্টিটিউট যৌথভাবে বিগত পাঁচ বছর ধরে বাংলা ভাষা শেখার জন্য গ্রীষ্মকালীন ভাষা ক্যাম্প স্কুল শুরু করেছে। তবে করোনা মহামারির সময় দুই বছর স্থগিত থাকার পর এই বছর আবার তা শুরু হয়েছে। এই গ্রীষ্মকালীন স্কুলের পেছনে ধারণাটি হলো, বাংলা সংস্কৃতির কিছু উপাদানসহ, কথ্য বাংলা ভাষা শেখানো। প্রতিবছর এই কোর্স উল্লিখিত তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যেকোনো একটিতে আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

উদ্যোগটি প্রথম আয়োজিত হয়েছিল জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। দ্বিতীয়টি হয়েছিল চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগের চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ে আর এই বছর অনুষ্ঠিত হলো পোল্যান্ডের রাজধানীতে অবস্থিত ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই গ্রীষ্মকালীন ভাষা স্কুল কোর্স পরিচালনায় রয়েছেন তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানীরা। ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মিখাইল পানাসিউক, হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের চৈতি বসু ও চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্টিন হ্রিবেক।

এ বিশেষ ধরনের উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে প্রাথমিক অবস্থায় যাঁর অবদান অপরিসীম, তিনি হলেন, জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ইনস্টিটিউটে আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ান ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হান্স হার্ডার। এ বিষয়ে তিনি জানান, রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি থেকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাসংগ্রাম বা একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার ঘটনা ও অনুষঙ্গ বিদেশিদের বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে।

এই উদ্যোগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে বিদেশিদের আকৃষ্ট করছে, অনেকেই উৎসাহী হচ্ছেন বাংলাচর্চায়। এই বছর ওয়ারশতে আয়োজিত গ্রীষ্মকালীন বাংলা স্কুলে অংশগ্রহণকারীরা দুই সপ্তাহে প্রতিদিন ছয় ঘণ্টার ক্লাসে অংশগ্রহণ করেছে। বাংলা ভাষা শেখার এই স্কুলে শুধু অভিজ্ঞ শিক্ষকদের কাছ থেকে বাংলা শেখার সুযোগই দেয় না, বরং বাঙালি সংস্কৃতিতে আগ্রহী লোকদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগও করে দেয়। ভাষার ক্লাস ছাড়াও অংশগ্রহণকারীরা আরও কিছু বিশেষ বিষয় যেমন বাংলা চলচ্চিত্র, রান্নাবিষয়ক কোর্সে যোগ দেন। ভাষা ছাড়াও এসব কোর্সের উদ্দেশ্য হলো অংশগ্রহণকারীদের আধুনিক বাংলা বলার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটানো। মূলত বাংলা ভাষায় শিক্ষানবিশ এবং অগ্রসর উভয় ধরনের অংশগ্রহণকারীদের লিখিত পাঠের কিছু উপাদানসহ ইংরেজির মাধ্যমে আধুনিক কথ্য বাংলা শেখানো হয়।

এ বছর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী এবং উৎসাহীজনেরা ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কোর্সে অংশগ্রহণের জন্য আবেদন করেছিলেন। মোট ১৬ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ছিলেন জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, চেক প্রজাতন্ত্র, ক্রোয়েশিয়া, সুইজারল্যান্ড ও পোল্যান্ড থেকে আসা নাগরিকেরা। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কেউ বাংলাভাষী লোকদের সঙ্গে কাজ করেন, এমন পেশাদার ব্যক্তি। আবার কারও কারও পরিবারের বাংলাভাষী সদস্য রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে বাংলায় আরও নিবিড়ভাবে যোগাযোগ করার জন্যও কেউ এই কোর্সে ভর্তি হয়েছেন। কিছু অংশগ্রহণকারী আবার বাঙালি ঐতিহ্যের পটভূমি শেখার জন্য এই বিশেষ ভাষা স্কুলে যোগ দিয়েছিলেন।

এবারের এ কোর্সে যোগদানকারীদের মধ্যে ছিলেন ১৫ থেকে ৭১ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা। বাংলা ভাষার পারস্পরিক আগ্রহ থেকে এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন এক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, যা শ্রেণিকক্ষের বাইরেও সেতুবন্ধ গড়ে তুলেছে।

এ কোর্স সম্পূর্ণ করে এসে জার্মান বন্ধুবর স্কুলশিক্ষক জিগফ্রিড স্মিড আর ভারততত্ত্ব বিষয়ে শিক্ষিত বের্নহার্ড হের্টলাইন বললেন, বাংলা ভাষা শিক্ষা কোর্স একটি অনন্য উদ্যোগ। সারা পৃথিবীতে প্রায় ২৬ কোটি মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। সব ভাষার মধ্যে সপ্তম স্থানে রয়েছে বাংলা ভাষা। এই অনবদ্য ভাষা কোর্সে যোগ দেওয়ার পর থেকে বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতিকে আমরা আরও গভীরভাবে বুঝতে পারছি। নিঃসন্দেহে গ্রীষ্মকালীন বাংলা স্কুলের এই উদ্যোগ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পণ্ডিত-গবেষকদের মধ্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চা নিয়ে আগ্রহের নতুন দরজা খুলে দেবে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn