-সুজাত মনসুর

অসম্ভব সম্ভাবনাময় বহুমাত্রিক প্রতিভা নিয়ে জল-জোস্নার শহর সুনামগঞ্জে জন্ম পীর হাবিব-এর। গ্রামীণ আদলে গড়ে ওঠা ছোট্ট মহকুমা শহরের(বর্তমানে জেলা সদর) হাসননগরে একটি সম্ভ্রান্ত প্রগতিশীল মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান পীর হাবিবুর রহমান ভাইদের মধ্যে চতুর্থ। বড় দুই ভাইয়ের নাম এ মুহুর্তে মনে পড়ছে না। তৃতীয় ভাইয়ের নাম এডভোকেট মতিউর রহমান পীর ও সর্বকনিষ্ঠ এডভোকেট ফজলুর রহমান পীর মিসবাহ এমপি। যতটুকু জানি বড় দুই ভাই মারা গেছেন অনেক আগেই। বাবা-মাও বেঁচে নেই। হাবিবও চলে গেল অকালে। জীবিত দুই ভাইয়ের শারীরিক অবস্থাও ভালো নয়। দু’জনের শরীরে নানা রোগ বাসা বেঁধেছে, তবুও ক্লান্তিহীন, কর্মঠ ও নীতিনৈতিকতা আর সততায় অবিচল। হাবিব যেমন মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে ছিলেন আপোষহীন তেমনি তাঁরাও। যদিও পীর মিসবাহ এখন জাতীয় পার্টির সাংসদ। তারও একটা অনিবার্য ও যৌক্তিক কারণ রয়েছে, যা এখানে আলোচনা সমুচিত নয়। শুধু বলে রাখি দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষকে তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এগিয়ে যেতেই হয় যেকোনো ভাবেই। মতিউর রহমান পীর অনেক অবহেলার পরও মুজিবাদর্শ ধারণ করে নিজের রাজনৈতিক ঠিকানাকে আঁকড়ে ধরে আছেন। রাজনৈতিক ঠিকানা হলো আওয়ামী লীগ, শুরু ছাত্রলীগ দিয়ে।

পীর হাবিবদের পরিবারের সাথে আমার সম্পর্কের স‚চনা একই রাজনৈতিক পরিবার অর্থাৎ আওয়ামী পরিবারের সদস্য হিসেবে। সময়টি বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী রাজনীতির চরম বৈরি সময়ে ছাত্রলীগ পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার প্রথম পর্বে ১৯৭৮ সালের এপ্রিল কিংবা মে’র দিকে। এর আগে আমাদের থানা দিরাইতে একই বছর মার্র্চের ৩১ তারিখে জেলা নেতৃত্বের সাথে কোন যোগাযোগ ছাড়াই থানা ছাত্রলীগের সম্মেলন করি। ইতোপ‚র্বে মতিউর রহমান পীরকে আহŸায়ক করে সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের কমিটি গঠিত হয়েছে সেটা আমাদের জানা ছিল না। যোগাযোগ ব্যবস্থা এত খারাপ ছিল যে মাত্র ১৪ মাইল যেতে লঞ্চ ও বাস(মুড়ির টিন) মিলিয়ে সময় লাগতো ৬/৭ ঘন্টা। তাই হয়তো জেলা আহŸায়ক কমিটির সাথে যোগাযোগ একটু দেরিতে হয়। মতিউর রহমান পীরের নেতৃত্বে সুনামগঞ্জে ছাত্রলীগ পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে পড়ি। ৬/৭ ঘন্টা জার্নি করে মাঝে মাঝেই সুনামগঞ্জ চলে যাই। ফ্রী থাকা-খাওয়া মতি ভাইদের বাসায়। এভাবেই তাঁদের পরিবারের একজন অনিবার্য সদস্য হয়ে যাই। পুরো লেন্সের চশমা পড়া তাঁদের মেঝো ভাইয়ের আদর পেয়েছি অনেক। বড় ভাইয়ের সাথে তেমন দেখা হতো না। হাবিব সম্ভবত ক্লাস নাইন ও মিসবাহ সেভেনে পড়তো। বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করতো ওরা। এখনো সে সম্পর্কটা অটুট। ঐ সময়েই দেখেছি তাঁদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও চেতনা কত প্রগাঢ় ও তীক্ষè।

আন্দোলন, সংগ্রাম, ত্যাগ, তিতিক্ষা ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্বাধীন স্বদেশ ভ‚মিতে পিতা মুজিব হত্যার বিচার ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে, এক চরম বৈরি রাজনৈতিক পরিবেশে আমরা সেদিন যারা রাস্তায় মিছিল করেছি। ¯েøগান দিয়েছি। ছাত্রলীগ পুনর্গঠনে কিছটা হলেও ভ‚মিকা রেখেছি, পীর হাবিবুর রহমান তাঁদেরই একজন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা যখন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন প‚রণের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন প্রায় ৭৪ বছর তখন হাবিব ষাট পুর্ণ করার আগেই পাড়ি জমালো পরপারে। পীর হাবিবের অকাল প্রয়ান একটি অসমাপ্ত গল্পের মতো মনে হয়। মনে হয় হাবিবের তো অনেককিছু বলার ছিল। অনেককিছু হওয়ার ছিল। স্বপ্ন ছিল সার্বক্ষণিক রাজনীতিবিদ হবে, হতে পারেনি। তবে রাজনীতি তাঁকে ছেড়ে যায়নি। সেও রাজনীতি পরিত্যাগ করেনি। মিছিল ছেড়ে কলম ধরেছে। মাঠ ছেড়ে মিডিয়ায়। রাজনীতির মাঠে আজ ভেজালদের এতই দাপট ও দৌরাত্ম যে আসল ও পোড় খাওয়াদের নাভিশ্বাস। অথচ একটি অপরিহার্য ও গুরুত্বপ‚র্ণ সেক্টর মিডিয়াতে আমাদের দাপট ও উপস্থিতি খুবই কম। যারা আছে তাঁদের বেশিরভাগই পঙ্কে নিমজ্জিত। নীতিনৈতিকতা আর আদর্শহীন। মুখে শেখ ফরিদ বগলে ইট।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অধ্যয়নকালে ১৯৯৪ সালে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হাবিবের। ১৯৯২ সালে বাংলা বাজার পত্রিকার প্রতিষ্ঠালগ্নে তাঁর পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। তারপর যুগান্তর, আমাদের সময়, আমাদের অর্থনীতি ও বাংলাদেশ প্রতিদিন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হাবিব বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর সম্পাদক নঈম নিজাম ও হাবিব হরিহর আত্মা। তাঁদের দুজন শুধু বন্ধুই নয়, আপন ভাইয়ের মত। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস তাঁর মৃত্যুর সময় সবচেয়ে কাছের মানুষ, প্রাণের মানুষ নঈম নিজাম কাছে নেই। এক বিশেষ কাজে ৫ তারিখে অর্থাৎ হাবিবের মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগে বিদেশে পাড়ি জমাতে হয়। এ কষ্ট, দুঃখ তাঁকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে বাকী জীবন।

পৃথিবীতে যাদের জন্মই হয় কেবল জয়ী হওয়ার জন্য। মানুষের ভালোবাসার জন্য। মানুষকে ভালোবাসার জন্য। মানুষের জন্য অবিরাম অন্তহীন যুদ্ধ করার জন্য। পীর হাবিব তাঁদেরই একজন। রাজনীতির মাঠে যেমন দাপটি ছিল সাংবাদিকতায়ও তাই। এত অল্প সময়ে যে সমসাময়িককালের একজন প্রথিতযশা, জনপ্রিয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট হওয়া যায় পীর হাবিবুর রহমান তা প্রমাণ করেছে মেধা, শব্দশৈলী, কমিটমেন্ট, দক্ষতা ও সাহস দিয়ে। হাবিবের মতো এত সাহসী কলম যোদ্ধা সত্যিই বিরল। হাবিবের কলম থামিয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হয়েছে। কুৎসা রটনা করা হয়েছে। চরিত্রে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা হয়েছে। হুমকি ধামকি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু হাবিবের কলম থেমে যায়নি বরং ঝলসে ওঠেছে বারবার। টকশোতে হাবিব মানেই জমজমাট। যুক্তির পর যুক্তিতে প্রতিপক্ষ কপোকাত।

সিলেটবাসীর প্রানের মানুষ, প্রিয়জন, প্রিয় কলামিস্টের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের উদ্দেশ্যে অত্যন্ত আবেগময় কান্নাজড়িত কন্ঠে পীর মিসবাহ জানিয়েছে, মৃত্যুর আগ মুহ‚র্তেও পীর হাবিব চেষ্টা করেছে প্রতি বুধবারের তাঁর নিয়মিত লিখতে। শারীরিক অসুস্থতার জন্য নিজ হাতে লিখতে পারবে না তাই অন্যজনের সহযোগিতায়। কিন্তু শরীর এতোটাই খারাপ হয়ে পড়ে যে তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। মিসবাহ আরও বলেছে, ভারত থেকে ক্যান্সার জয় করে সুস্থ হয়ে ফিরে আসার পর পীর হাবিবের ইচ্ছে ছিল আত্মজীবনী লেখার, কিন্তু তা অপ‚র্ণ থেকে গেলো। ‘জেনারেলের কালো সুন্দরী’ নামে হাবিবের একটা উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৮ সালে অন্য প্রকাশ থেকে। উপন্যাসটি একটি রাজনৈতিক উপন্যাস, স্থান পেয়েছে ইয়াহিয়া-ভুট্টো থেকে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর লাম্পট্য জীবনের ইতিবৃত্ত। আরেকটি বই প্রকাশিত হয় ২০২০ সালের বইমেলায় একই প্রকাশনী থেকে, নাম ‘বলিউডের ট্র্যাজিক প্রেম’। বইটির বিষয় বলিউডের নায়ক নায়িকাদের গোপন প্রেম ও বিশ্বাসঘাতকতা। দুটি বই ব্যাপক পাঠকের মন কাড়তে সক্ষম হয়। বিশেষ করে উপন্যাসটি। রাজনৈতিক উপন্যাস সবাই লিখতে পারে না, সাহস লাগে। রাজনৈতিক ইতিহাস, ঘটনা প্রবাহ ও পাত্র পাত্রীদের সম্পর্কে প্রভ‚ত জ্ঞান থাকতে হয়। চাইলেই ঘটনা প্রবাহ, পাত্র পাত্রী বদলে দেওয়া যায় না। তাই দেখা যায় রাজনৈতিক উপন্যাসের বড়ই ঘাটতি। হাবিব সে ঘাটতি পুরণের চেষ্টা করেছে। বেঁচে থাকলে হয়তো আরও রাজনৈতিক উপন্যাস উপহার দিতে পারতো। যারা নিয়মিত কলাম লিখেন তাঁদের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি হয়। একজন ভালো উপন্যাসিক কিংবা রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ধর্মী ও ঘটনা বহুল গ্রন্থ রচনার সম‚হ সম্ভাবনা থাকা সত্তে¡ও সময়ের অভাবে মানুষের প্রত্যাশা প‚রণ করতে পারেন না। অথচ বই হলো চিরস্থায়ী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। অধিকাংশ কলামই যেহেতু বর্তমানকে ঘিরেই আবর্তিত হয় বেশি তাই ঘটনার আবেদন ফুরিয়ে গেলে কলামের আবেদনও শেষ হয়ে যায়। তারপরও সংখ্যায় কম হলেও এমন অনেক কলাম আছে যা রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক গুরুত্ব বিবেচনায় আবেদন থেকে যায় যুগের পর যুগ। কালের স্বাক্ষী ও ভবিষ্যৎ রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে যুগ যুগান্তর। পীর হাবিবেরও এমন অনেক কলাম আছে যা গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হলে ভবিষ্যতে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এই কাজটি যাতে সমাপ্ত হয় সে ব্যবহারে তাঁর কলিক ও পরিবারকেই উদ্যোগি হতে হবে। নতুবা অপ্রিয় হলেও সত্য, আবেগ ফুরিয়ে গেলে একদিন হাবিবও হারিয়ে যাবে অনেক অগ্রজ কলামিস্টের মতো। বিশিষ্ট কলামিস্ট ও একুশে গানের রচয়িতা এখন জীবন সায়াহ্নে। তিনি কেবল ত্রিকালদর্শীই নন, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস ও স্বাধীনতা পরবর্তী অনেক ঘটনার স্বাক্ষী। তাঁর অজস্র কলাম রয়েছে। কিন্তু একুশের গান ব্যতিত এমন কোন বিশেষ গ্রন্থ রেখে যাননি যা ভবিষ্যতে ইতিহাসের প্রয়োজনে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এখন তো আর সম্ভব নয়। তবে কেউ যদি উদ্যোগি হয়ে তাঁর কালোত্তীর্ণ কলামগুলো গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করে তাহলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে রেফারেন্স হতে পারে। তিনি যদি আত্মজীবনীটা লিখতেন তাহলেও জাতি উপকৃত হতো। আত্মজীবনীর প্রতি লেখক, সাংবাদিক বিশেষ করে যারা ইতিহাসের অনেক ঘটনার স্বাক্ষী তাঁদের অনীহার কারণ কি সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে ভয় পাওয়া? একই কথা বলা যায় রাজনীতিবিদদের বেলা। পীর হাবিব সদালাপী ও আড্ডা প্রিয় মানুষ হিসেবে অনেক রাজনীতিবিদের সাথে মধুর সম্পর্ক ছিল। অনেক ঘটনা প্রবাহের স্বাক্ষী। যদি আত্মজীবনী লিখে যেতে পারতো তা ইতিহাসের অম‚ল্য দলিল হতো। জীবনের গল্পটা প‚র্ণতা পেতো। ভালো থেকো পরপারে প্রিয় ভাই হাবিব।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn