অদ্বৈত মারুত- বাংলা কথাসাহিত্যের প্রাণপুরুষ শওকত আলী আর নেই। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। শওকত আলীর বড় ছেলে চিকিৎসক আরিফ শওকত পল্লব গতকাল জানান, আজ (বৃহস্পতিবার) সকাল সোয়া আটটার দিকে তার বাবাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। ফুসফুসের সংক্রমণ, কিডনির জটিলতা ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা নিয়ে গত ৪ জানুয়ারি ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। প্রথমে আইসিইউতে রাখা হলেও, পরে অবস্থার অবনতি হলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছিল। এর পর ১৬ জানুয়ারি তাকে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে স্থানান্তর করা হয়। সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরবেন, আকুল প্রার্থনা ছিল অনুরাগীদের সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে যেতে হল তাকে। তিনি চলে গেছেন, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে গেছেন অসংখ্য সৃষ্টি। তার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার জন্য শওকত আলীর অবদানের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, তার মৃত্যু এ ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি। প্রধানমন্ত্রী মরহুমের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। শওকত আলীর মৃত্যুতে দেশের সাহিত্যাঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে গল্প ও উপন্যাস লিখে যে কয়জন ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন, তার মধ্যে শওকত আলী অন্যতম। তিনি একাধারে কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিক্ষক। অবিরাম লিখেছেন হাত খুলে; সব্যসাচীর মতো উদ্দীপিত মননে ও অনুধ্যানে। তার হাত দিয়ে বের হয়েছে ক্রমাগত কালজয়ী সব গল্প ও উপন্যাস। সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৯০ সালে একুশে পদকে ভূষিত করে। শওকত আলীর জন্ম ১৯৩৬ সালের ১২ ফ্রেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর জেলার থানা শহর রায়গঞ্জে। শ্রীরামপুর মিশনারি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির মাধ্যমে শওকত আলীর পড়াশোনায় হাতেখড়ি হয়। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতা আক্রান্ত হলে তার পরিবার আবার গ্রামে ফিরে আসেন। মা যোগ দেন রায়গঞ্জের বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে। বাবা শুরু করেন ডাক্তারি বিদ্যা। শিশু শওকত আলীকে বাবা-মা তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন নিজ গ্রামের রায়গঞ্জ করনেশন ইংলিশ হাইস্কুলে। ১৯৫১ সালে তিনি করনেশন স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ওই বছরই তিনি ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। মায়ের মৃত্যুর পর ১৯৫২ সালে শওকত আলী ভাইবোনদের নিয়ে বাংলাদেশের দিনাজপুরে এসে বসতি স্থাপন করেন। বাবা পরে দিনাজপুরে চলেন আসেন ১৯৫৩ সালে। ১৯৫৩ সালে দ্বিতীয় বিভাগে আইএ পাস করেন। বিএতে ভর্তি হন ওই কলেজেই। শওকত আলী কলেজ জীবনেই কমিউনিস্ট দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। বিভিন্ন মিছিল, আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এ সময়। ১৯৫৪ সালে তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। ছাড়া পান ডিসেম্বরেই। ১৯৫৫ সালে বিএ পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে বাংলায় এমএ ক্লাসে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৮ সালে এমএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বিয়ে করে সংসারজীবন শুরু করেন ১৯৬১ সালে। শওকত আলী নবম শ্রেণিতে পাঠরত অবস্থায় লেখালেখি শুরু করেন। ভারত ভাগের পর কলকাতার বামপন্থিদের পত্রিকা ‘নতুন সাহিত্য’-এ তার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। তবে ১৯৫৫ সাল থেকে তার লেখা বিভিন্ন কাগজে প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। এ বছরই তিনি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকার নিউজ ডেস্কে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে দিনাজপুরের একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে এবং পরের বছর বাংলার প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন ঠাকুরগাঁও কলেজে। শওকত আলী ১৯৬২ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) এবং ১৯৮৮ সালে জেলা গেজেটিয়ারের ঢাকার হেড অফিসে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করে পরিচালক পদে উন্নীত হন। ১৯৮৯ সালে সরকারি সংগীত কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ (১৯৮৪) উপন্যাসটি শওকত আলীকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দেয়। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে তার হাত দিয়ে প্রথম রচিত হয় ‘পিঙ্গল আকাশ’ (১৯৬৩); ‘যাত্রা’ (১৯৭৬); ‘অপেক্ষা’ (১৯৮৪); ত্রয়ী উপন্যাসÑ ‘দক্ষিণায়নের দিন’ (১৯৮৫), ‘কুলায় কালস্রোত’ (১৯৮৬) ও ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’ (১৯৮৬); ‘সম্বল’ (১৯৮৬); ‘গন্তব্যে অতঃপর’ (১৯৮৭); ‘ভালোবাসা কারে কয়’ (১৯৮৮)‘ ‘ওয়ারিশ’ (১৯৮৯); ‘বাসর ও মধুচন্দ্রিমা’ (১৯৯০); ‘উত্তরের খেপ’ (১৯৯১); ‘প্রেমকাহিনী’ (১৯৯১); ‘পতন’ (১৯৯২); ‘অবশেষে প্রপাত’ (১৯৯৬); ‘দলিল‘ (২০০০); ‘জননী ও জাতিকা’ (২০০১); ‘হিসাব নিকাস’ (২০০১); ‘স্ববাসে প্রবাসে’ (২০০১); ‘তনয়ার স্বীকারোক্তি’ (২০০১); ‘জোড় বিজোড়’ (২০০১); ‘ঘরবাড়ি (২০০১); ‘শেষ বিকেলের রোদ’ (২০০১); ‘এক ডাইনীর খেলা’ (২০০১); ‘নাঢ়াই’ (২০০৩); ‘বসত’ (২০০৫); ‘স্থায়ী ঠিকানা’ (২০০৫); ‘দুইরকম’ (২০০৫); ‘কাহিনী ও কথোপকথন’ (২০০৭); ‘মাদার ডাঙ্গার কথা’ (২০১১)। তার লেখা কালজয়ী গল্পগুলো যথাক্রমেÑ ‘উন্মুল বাসনা’ (১৯৬৮); ‘লেলিহান সাধ’ (১৯৭৮); ‘শুন হে লখিন্দর’ (১৯৮৮); ‘বাবা আপনে যান’ (১৯৯৪); ‘দিন গুজরান’ (২০০৬) ইত্যাদি। বস্তুত কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর লেখার জগতে মেধাবী যাত্রা শুরু নবম শ্রেণিতে ছাত্রাবস্থায়। ভারত ভাগের পর ‘নতুন সাহিত্য’ নামে একটি পত্রিকায় তার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, পত্রিকাটির পরিচালনায় ছিল কলকাতার বামপন্থিরা। এর পর তার অনেক গল্প, কবিতা ও শিশুতোষ লেখা অবিরত প্রকাশিত হতে দেখা যায় ‘দৈনিক মিল্লাত’, ‘মাসিক সমকাল’, দৈনিক ইত্তেফাক’-এ। তার ‘দক্ষিণায়নের দিন’, ‘কুলায় কালস্রোত’ ও ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’ ত্রয়ী উপন্যাসের জন্য তিনি ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬) লাভ করেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn