বিভিন্ন কাজে দুর্নীতি এবং কলেজ ফান্ড থেকে অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মের দায়ে রাজধানীর মিরপুর কলেজের অধ্যক্ষ মো. গোলাম ওয়াদুদকে বরখাস্ত করেছে ব্যবস্থাপনা কমিটি। একইসঙ্গে তার মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার (এমপিও) স্থগিত করা হয়েছে। আলোচিত এই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ২৫ কোটি টাকারও বেশি আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার নামে পাওয়া গেছে তিনটি ফ্ল্যাটের সন্ধান। তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা করার নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর এবং কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটি সূত্রে জানা গেছে, শনিবার (২১ আগস্ট) কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি শরিফ এনামুল কবিরের নেতৃত্বে বৈঠকে অধ্যক্ষকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কলেজের উপাধ্যক্ষ মো. মাহবুবুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের (ডিআইএ) তদন্তে অধ্যক্ষ ওয়াদুদের বিরুদ্ধে কলেজের ফান্ড থেকে অর্থ আত্মসাৎসহ অনেক অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৭ আগস্ট তার এমপিও স্থগিত করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর।

তদন্তে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ) তার বিরুদ্ধে মোট ৩৪টি আর্থিক ও প্রশাসনিক অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে। ডিআইএর প্রতিবেদনকে আমলে নিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে মাউশি।

প্রথম অভিযোগ, অধ্যক্ষ গোলাম ওয়াদুদের ঢাকায় নিজের নামে তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে। তার নামে ডাকঘর ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের প্রমাণ মিলেছে। এর সঙ্গে তার আয়ের কোনো সংগতি পাওয়া যায়নি। কলেজের তহবিল থেকে অধ্যক্ষ দুই ধাপে মোট ৮ লাখ টাকা নিয়েছেন। যার কোনো ভাউচার নেই। এ টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন।

অধ্যক্ষ গোলাম ওয়াদুদের নিয়োগও ছিল অবৈধ। তাকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদান করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এমপিও নীতিমালা (৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১০ প্রণীত মার্চ ২০১৩ পর্যন্ত সংশোধিত) লঙ্ঘন করে পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করায় অধ্যক্ষের নিয়োগ বিধিসম্মত হয়নি বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এছাড়াও অধ্যক্ষ গোলাম ওয়াদুদ ২০১৮ সালে কলেজ তহবিলের দুই লাখ টাকা হিসাবরক্ষক লরেন্স পলাশের কাছ থেকে গ্রহণ করেন, যা আত্মসাৎ হিসেবে গণ্য। বিধি-বহির্ভূতভাবে দেওয়া পারিতোষিকের ১২ লাখ ৩৩ হাজার ৫৭ টাকা আদায়যোগ্য। নির্মাণ খাতে ব্যয় হওয়া ৬ লাখ ৮০ হাজার টাকার ভাউচার গ্রহণযোগ্য নয়, তাই তা আত্মসাৎ হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। নির্মাণ ও উন্নয়ন খাতে ব্যয় হওয়া ৫৮ লাখ ৩২ হাজার টাকার ভাউচারের অভিযোগ সম্পর্কে কোনো রেকর্ড পায়নি তদন্ত কমিটি।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, লিপি ফার্নিচার মার্টকে ১৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হলেও বিলটি চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়নি। দুজন হিসাবরক্ষককে সম্মানী বাবদ দেওয়া ১৬ হাজার টাকা আদায়যোগ্য।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, টি-২০ বিশ্বকাপ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ৭ হাজার ৩০০ টাকা ব্যয় করা হয়। যার কোনো ভাউচার নেই, তাই এ অর্থ আত্মসাৎ হিসেবে গণ্য হবে। বিধি-বহির্ভূতভাবে ১০ লাখ ১৭ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে, যা আত্মসাৎ হিসেবে গণ্য। কলেজ কর্তৃক দখলকৃত সরকারি স্থাপনায় কর্তৃপক্ষের অনুমতি-বিহীন ২ লাখ ৯৬ হাজার টাকা ব্যয় গ্রহণযোগ্য নয়। বিধি-বহির্ভূতভাবে ১৯ লাখ ৮০ হাজার টাকার ফার্নিচার তৈরির কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ লাখ ৪ হাজার টাকা আত্মসাৎ হিসেবে গণ্য হবে। শিক্ষা সফরে ব্যয় হওয়া টাকার মধ্যে ৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ হিসেবে গণ্য হবে।

২০১৮ সালে ৩১ মার্চ মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবিরোধী পথসভার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে ব্যয় হওয়া ১৮ লাখ ৪৯ হাজার টাকার বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ব্যয় গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা আত্মসাতের সামিল। শান্তি পতাকা বাবদ ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বিধি মোতাবেক ব্যয় করা হয়নি। একজন অধ্যক্ষ সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা নগদ খরচ করতে পারেন। এর বেশি খরচ করতে হলে তাকে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে খরচ করতে হবে। কিন্তু অধ্যক্ষ গোলাম ওয়াদুদ মোট ২৪ কোটি ২৫ লাখ ৯৩ হাজার টাকা নগদ ব্যয় করেছেন, যা বিধিবহির্ভূত। এছাড়া কলেজের টিসিসহ বেশ কয়েকটি খাতে অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে।

কলেজের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ব্যাপক গরমিল পেয়েছে তদন্ত কমিটি। কলেজের লিখিত আয়ের মধ্যে ৫ কোটি ২৪ লাখ ৬ হাজার ৩৫৭ টাকার গরমিল রয়েছে। শিক্ষার্থীদের পোশাক তৈরি বাবদ ১ লাখ ১ হাজার ৬০০ টাকার কোনো ভাউচার নেই। এটা আত্মসাৎ করা হয়েছে। নিবন্ধন সনদ ছাড়াই শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কলেজের উন্নয়ন উপ-কমিটিকে সম্মানী বাবদ ১২ লাখ ৩৭ হাজার ৭০০ বিধি-বহির্ভূতভাবে দেওয়া হয়েছে। সরকারকে ভ্যাট দিয়েছে বলা হয়েছে ৪৫ লাখ ৪৮ হাজার ২১৮ টাকা, যা কলেজের রেজিস্ট্রার বা কোনো নথিতে উল্লেখ নেই। এ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করা হয়নি।

জানতে চাইলে কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর শরিফ এনামুল কবির বলেন, ‘তদন্তের আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে আমার কোনো বক্তব্য নেই।’

এসব অভিযোগের ব্যাপারে অধ্যক্ষ মো. গোলাম ওয়াদুদ বলেন, ‘প্রত্যেকটি অভিযোগের পক্ষে আমি ডকুমেন্ট দিয়েছি। তারপরও আমার বিরুদ্ধে এক তরফা প্রতিবেদন দিয়েছে ডিআইএ। এ প্রতিবেদন বাতিল চেয়ে আবেদন করবো আমি।’

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn