জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে কাঁদলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি কাঁদালেন অসংখ্য নেতা-কর্মীকেও। বাংলা একাডেমির আয়োজনে সোমবার বিকালে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বইটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে দেশের স্বাধীনতা ও মানুষের মুক্তির প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রাম, কারাভোগের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন শেখ হাসিনা। পিতার সঙ্গে দীর্ঘ স্মৃতি বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। তিনি নিজে কাঁদলেন, কাঁদালেন উপস্থিত সবাইকে। কখনো বাবা শেখ মুজিব, কখনো মা ফজিলাতুন নেছা মুজিব, কখনো ছোটভাই শেখ রাসেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। প্রায় ৩২ মিনিটের বক্তৃতায় বার বার চোখের পানি মুছেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। শেখ হাসিনার চোখে পানি দেখে কেঁদেছেন সবাই। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদেছেন কর্মীদের অনেকে। সেখানে উপস্থিত বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ সব শ্রেণি-পেশার বিশিষ্টজনরাও অশ্রু সামাল দিতে পারলেন না।   সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘কারাগারের রোজনামচা’ গত ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে প্রকাশ করা হলেও গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতেই আলোচকদের নিয়ে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কারাগারে থাকার সময় বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে লেখা নিয়ে রচিত এ বইটির নামকরণ করেন তার কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে প্রকাশনা উৎসবে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। গ্রন্থটির কিছু অংশ পাঠ করেন সংস্কৃতি বিষয়কমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। আলোচনায় অংশ নেন দেশের দুই শীর্ষস্থানীয় ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও অধ্যাপক ড. মুনতাসির মামুন। সভাপতির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ওপর গবেষণা করে একটি বস্তুনিষ্ঠ পূর্ণাঙ্গ জীবন রচনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু আর কিছুদিন বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ আরও অনেক আগেই উন্নত-সমৃদ্ধ হতো। কিন্তু তিনি সেই সময় পাননি। অনেকে তাকে সেই সময়টুকুও দিতে চাননি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেকে কত সমালোচনা করেছেন। এভাবে তারা যেন স্বাধীনতার পরাজিত শক্তির হাতকেই শক্তিশালী করলেন। বঙ্গবন্ধুর হাতে লেখা এসব দুর্লভ পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি নিয়ে কথা বলতে গেলে সর্বাগ্রে আমার মায়ের (ফজিলাতুন নেছা মুজিব) কথা মনে পড়ে। আজীবন তিনি বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন, অনুপ্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছেন। নিজের জন্য কোনো সময়ই কিছু চাননি। তাই বঙ্গবন্ধু যখনই গ্রেফতার হতেন তখনই আমার মা তার হাতে খাতা ধরিয়ে দিতেন, লেখার ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। কারাগার থেকে মুক্তির পর বঙ্গবন্ধুর লেখা খাতাগুলো যত্ন করে ধানমণ্ডির বাসায় রেখে দিতেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ছয় বছর পর দেশে ফিরতে পেরেছি। তবে প্রথমে আমাদের বাসায় যেতে দেওয়া হয়নি। যখন প্রথম বাসায় গেছি তখন প্রধান লক্ষ্যই ছিল বঙ্গবন্ধুর হাতে লেখা খাতাগুলো সংগ্রহ করার। ওই সময় বাসায় থেকে আমরা কিছুই নিয়ে আসিনি। কেবল নিয়ে এসেছিলাম কারাগারে থাকতে বঙ্গবন্ধুর লেখা খাতাগুলো। এত ঝড়-ঝাঞ্ঝার মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর লেখাগুলো খুঁজে পেয়েছি। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই খাতাগুলো পড়া আমাদের দুবোনের জন্য যে ভীষণ কষ্টের ও বেদনার ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।   অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানার উপস্থিত না থাকার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এ অনুষ্ঠানে রেহানা আসতে পারেনি। কারণ কয়েকদিন আগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সন্ত্রাসী হামলা হলো। রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মেম্বার। যে সময় হামলা হয়, সে সময় সংসদের ভিতরে টিউলিপ ও তার মেয়ে ছিল। খবর পেয়েই পরদিন রেহানা সেখানে চলে যায়। এই অনুষ্ঠানে ওর থাকার কথা ছিল। তাই সে আসতে পারেনি। আমি আসার আগে ওর সঙ্গে কথা বলেছি। কারণ আমি চাই ও (রেহানা) আমার পাশে পাশে থাকুক। শেখ হাসিনা বলেন, এ বইটিতে একটি খাতা ১৯৬৮ সালের। এটাই জাতির পিতার শেষ লেখা। এই খাতা নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি রয়ে গেছে। জানুয়ারি মাসের পর থেকে আমরা কিছুই জানতে পারতাম না তিনি কোথায়, কিভাবে আছেন, কি করছেন। তাকে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ক্যান্টনমেন্টে রাখা হয়। এরপর আমরা মাঝে মধ্যে দেখা করার অনুমতি পেতাম। অফিসার্স মেসে তাকে রাখা হতো। একটি বালিশের নিচে খাতা রাখা ছিল। সেই খাতায় হাত দিয়ে পড়া শুরু করলাম। আব্বা-মা পাশাপাশি বসা ছিলেন। আব্বা উঠে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বকাও দিলেন না—কিছুই বললেন না। শুধু হাত থেকে খাতা নিয়ে বললেন এখন পড়বি না। আমার মৃত্যুর পর পড়বি। আমার হাত থেকে খাতাটি রেখে দিলেন। এ কথা বলে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন শেখ হাসিনা। কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, ৭৫’র পর যখন খাতাগুলো হাতে পেলাম তখন আর খাতাগুলো পড়তে পারিনি। বার বার বাবার সেই কথাটি মনে পড়ত। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা বই প্রকাশে যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এ কাজে যারা সাহায্য করেছিল, তাদের সবাইকে একে একে হারিয়েছি। ড. এনায়েতুল্লাহ রহিম সাহেবকে নিয়ে প্রথমে কাজ শুরু করি। বেবী মওদুদ আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু, সেও চলে গেল। অধ্যাপক শামসুল হুদা হারুন, মাহবুবুল হক শাকিল, সেও মারা গেছে। কেন একে একে সবাইকে হারাচ্ছি জানি না। শুধু শামসুজ্জামান ভাই (বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক) বেঁচে আছেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু আমার পিতা হলেও তিনি জনগণের। তিনি জনগণের সম্পদ। বাড়ি থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর যা কিছু আছে সবই জনগণের জন্য দান করেছি। একটাই লক্ষ্য দেশটাকে গড়ে তোলা। বঙ্গবন্ধুর আরও অনেক লেখা ও তথ্য বই আকারে প্রকাশের উদ্যোগের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বই-ই শেষ নয়। আমাদের কাছে আরও অনেক লেখা ও তথ্য রয়েছে। ধীরে ধীরে সবই আমরা বই আকারে প্রকাশ করব। ২০২০ সালে আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী পালন করব। আর জন্ম শতবার্ষিকীর মধ্যেই আমরা সব লেখা নিয়ে বই প্রকাশ করব।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ দেশের মানুষের জন্য আমার পিতা-মাতা, ভাইরা জীবন দিয়ে গেছেন। আমরা দু’বোনও বাড়িসহ সবকিছুই জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছি। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু কারাগারে থেকে যেসব নেতার সুনাম করে অনেক কথা লিখেছেন, পরে অনেকেই তার সঙ্গে বেইমানি করেছেন। বঙ্গবন্ধু যার সম্পর্কে যা যা লিখে গেছেন, তার একটা লাইনও আমরা কাটিনি। যেভাবে লিখেছেন সেভাবেই বইয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। যারা পরে বঙ্গবন্ধুর বিপক্ষে গিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই মারা গেছেন। আর যারা বেঁচে আছেন, তারা এই বইটি পড়ে নিশ্চয় কৃতকর্মের জন্য লজ্জা পাবেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn