হুমায়ূন রশিদ চৌধূরী-হুমায়ূন রশিদ চৌধূরী-খ্যাতিমানদের সম্পর্কে কিছু লিখার দায়িত্ব অযোগ্য লোকের হাতে পড়লে কি অবস্থা হয় তা সহজেই অনুমেয়। ব্যক্তিটি যদি আবার একাধারে শিক্ষক,কবি,সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হন-তাহলেতো আর কথা নেই। আমার ঘাড়ে সে দায়িত্বটাই বর্তিয়েছে। অবস্থাটা কি দাড়িয়েছে একবার ভাবুন। বাংলা সাহিত্যের দিক পাল অধ্যাপক ড.আনিসুজ্জামান সাহেব মৃত্যু বরন করার পর আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার সাহেবকে বলেছিলাম, ‘আনিসুজ্জামান সাহেব সম্পর্কে কিছু লিখুন। আপনি তার স্নেহ ধন্যদের একজন।’ শাহরিয়ার সাহেবের সাফ জবাব, ‘সব বিষয়ে হাত দিতে নেই। আনিসুজ্জামান সাহেব অত্যন্ত উচু স্থরের বিজ্ঞজন। তার সম্পর্কে লিখতে গেলে আরো গভীরে জানতে হবে। পড়তে হবে।’’ এর অর্থ যা বুঝলাম : গুনীজনদের যথার্থ মূল্যায়ন করতে না পারলেও তাকে যেমন-তেমন উপস্থাপন করা সঠিক নয়।

ইমানুজ্জামান মহী। গ্রন্থের সম্পাদক। লন্ডনে থাকেন। সম্পর্কে মামা। বেশ আগ থেকেই নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে লিখার তাগিদ দিচ্ছেন। প্রতিবারই সুনিপুন ভাবে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাই। বৈশ্বয়িক বিপর্যয় করোনাকালীন সময়। মেঝো মেয়ে মাহজাবিন বেশ অসুস্থ। দুঃশ্চিতায় কয়টা দিন সিলেটের নূরজাহান হাসপাতালে কাটালাম। মানুসিক ভাবে বেশ বিপর্যস্থ । অসুস্থ মন মানুসিকতা নিয়ে লিখতে চাইলে কি লেখা যায়?  অন্ধের মত কসরত করে যাই। মামাকে লিখবো প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলেছি। শব্দের কপাটতো খুলেনা। অসহায় হয়ে ভাবি। কি লিখি? মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কতো কি। পেটে বোমা মারলেও যেনো একটি শব্দ বের হবে না। মেয়েটি বাসায় এসেছে। বেশ ভালো।

পারিবারের কাছে তিনি গোলাপ মিয়া। গোলাপ মিয়ার যৌবনকাল। অর্থাৎ তিনি যখন বিয়ে করেন তখন আমার জন্ম হয়নি। কৈশোরে পারিবারিক আলাপে। আত্মীয়তার সুবাদে । গোলাপ মিয়ার নাম শুনতাম। মাঠে ময়দানে তার বেশ নাম-ডাক। সম্পর্কে আমাদের ভাই। দেখা হলেই বাইসাইকেলের উপর থেকে বলতেন, ‘মোহনপুরের চৌধূরী মিয়া কই যাও, লেখা পড়া ঠিক আছেতো?’

আমার জীবনের বেশীর ভাগ সময় যার সাথে কেটেছে তিনি বাহারুল ইসলাম। গোলাপ ভাইসাব বাহার ভাই‘র আপন ভগ্নিপতি। বাহার ভাই‘র কারনে উনার বড় বোনকে বড় আপা ডাকলেও আপার স্বামীকে কখনো দুলাভাই ডাকিনি। বিয়ের আগে তিনি যেমন ভাই ছিলেন তেমনি বিয়ের পরও ভাইসাব থেকে যান। গোলাপ ভাই‘র অনেক গল্প শুনতাম উনার শালক বাহার ভাইয়ের কাছে। বাড়ীর বড় জামাই। শ্বশুরবাড়ী  তার আদরকদর ছিল ভিন্ন মাত্রার। গোলাপ ‘ভাইসাব’  সৌখিন ছিলেন। চলাফেরা কথাবার্তার স্টাইল ছিলো আলাদা। শ্বশুর বাড়ীতে জামাইয়ের তাই বাড়তি কদর ছিল। ফুলের মাঝে ফুলের রাজা গোলাপ যেমন পায়। ঠিক যেনো তেমনি।

৮০ দশকে গোলাপ ভাই‘র এক মাত্র পুত্র সন্তান গালিব অসুস্থ হলে তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকায় তৎকালীন পিজি হাসপাতালে। আপা গালিবকে নিয়ে হাসপাতালে। গোলাপ ভাই থাকতেন পুরান ঢাকার মহাজনপুর লেন হাসান শাহরিয়ার চাচার বাসায়। ঘুম থেকে উঠে দেখতাম খাটের এদিক সেদিক ছড়ানো ছিটানো সিগারেটের অসংখ্য ধ্বংসাবশেষ । কিশোর গালিবের ছিল কিডনী সমস্যা। যতদূর মনে পড়ে এই সময়ই গোলাপ ভাই পুত্র শোকে খুব ভেঙ্গে পড়ে্ন। তার মাঝে কিছুটা উদাসিনতা চলে আসে। গালিবকে দেখতে বাহার ভাইয়ের সাথে আমিও পিজি‘তে যেতাম। গোলাপ ভাই হঠাৎ হঠাৎ হাসপাতালে এসে উদয় হতেন। যখন আসতেন একগাধা কাগজপত্র আর ম্যাগাজিন পত্রিকা বগলদাবা করে নিয়ে আসতেন। ঝড়ের গতিতে তার আসা আবার কিছুক্ষন থেমে সে ভাবে চলে যেতেন। কি যেনো এক অস্থিরতা কাজ করতো। খুব কম কথা বলতেন। একমাত্র ছেলে। কঠিন ব্যধি। আর্থিক টানা পোড়ন। হয়তো তাকে অন্য জগতের বাসিন্দা বানিয়ে দেয়।

গোলাপ ভাইয়ের জীবন ও কর্ম নিয়ে সেই কিশোর বয়সে আমার কোন মাথা ব্যথা ছিলনা এবং ঐ বয়সে তা থাকার কথাও নয়। কিন্তু জীবনের প্রথম যখন সুনামগঞ্জ কলেজে পা রাখলাম,তখন মাথায় চাপলো সাংবাদিকতা। সেই থেকে  নতুন করে চিনলাম গোলাপ ভাইসাবকে- তিনি যে মুহাম্মদ আবদুল হাই। পারিবারিক চৌধুরী টাইটেল বাদ দিয়ে তিনি শুধু মুহাম্মদ আব্দুল হাই। সাম্যন্তবাদী চিন্তা চেতনা ছেড়ে সাম্যবাদী চিন্তা চেতনায় বিশ্বাসী একজন শুদ্ধ মানুষ।

 তৎকালীন সময়ে তিনি ছিলেন সাংবাদিকতার প্রতিকৃত। খ্যাতিমান কবি, রাজনীতিবিদ, শিল্পী ও সমাজ সেবক। ৬০ দশক থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে ছাড়া সুনামগঞ্জে সাহিত্য,সংস্কৃতি, সাংবাদিকতার কথা কেউ ভাবতেন না। মেধা ও মননে তিনি সেই আসনটি ধরে রেখেছিলেন। ৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৫৬ দুর্ভিক্ষ, ৫৮ সালে আয়ূবখানের সামরিক শাসন, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ সহ এদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার অবদান ইতিহাসখ্যাত। ‘৭১ এর ২৫ মার্চ সেই কালো রাতের আগের দিন মুহাম্মদ আবদুল হাই সুনামগঞ্জ লেখক সমিতির পক্ষ থেকে জনমত নামে একখানি পত্রিকা বের করে। যা আলোড়িত করে সে সমম স্বাধীনতা প্রিয় মানুষকে। ঐ পত্রিকায় স্বাধীনতার চুড়ান্ত লক্ষ্যে সবাইকে ঝপিয়ে পড়ার দুর্বার আহ্বান ছিল।

 ‘সূর্যের দেশ’, ‘দেশের দাবি’, ‘সুরমা’, ‘দেশের কথা সহ অনেক পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পদনা করেছেন তিনি। অনেকেই বলতেন গোলাপ মিয়া যদি সুনামগঞ্জের মায়াজাল ছিন্ন করে ঢাকায় যেতেন তাহলে আজ তার নাম ছড়িয়ে যেতো জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।    

কিশোর বয়সে আমার নিকট তিনি ছিলেন হাজী মকুবুল হোসেন পুরকায়স্থ হাই স্কুলের(এইচএমপি) হেড স্যার। যিনি বাই সাইকেলে চড়ে ছোট্ট এই শহরের এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে ছুটতেন। চোখে মুখে কঠিন সংকল্প । দেখলেই মনে হতো কি যেন একটি মিশন নিয়ে ছুটছেন। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, সুদর্শন, চৌড়া বুক, উন্নত শির। চলনে বলনে নির্ভয়। ভীষণ আত্মবিশ্বাসী। ইংরেজি,বাংলায় সমান পারদর্শী এক পন্ডিত। এই বিরল ব্যক্তিত্বের মানুষটি মাত্র ৫৬ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ভাবলে অবাক লাগে। জীবনের অল্প সময়ে তিনি একজন সফল মানুষ। তার শিক্ষাজীবন, রাজনৈতিক জীবন, সাহিত্য সাংবাদিতকাতায় তিনি সফল। 

আঙ্গুলে গুনতি দিলে আমার লেখালেখির জগতে প্রায় ৪০ বছর। হাটি-হাটি, পা-পা করে নেশা কখন যে পেশায় পরিণত হলো বুঝতেও পারলামনা। কত রাত কত দিন ভুল-শুদ্ধে ভরা কত যে শব্দের মালা গেথেছি। কিন্তু মুহাম্মদ আবদুল হাইকে আমি কোন শব্দ মালায় গেথে নেবো-ভেবে পাইনা।  ভাটির জনপদের কৃতি সন্তান মুহাম্মদ আব্দুল হাই ব্যক্তি জীবনে  কি পেলেন না পেলেন সে বিষয়ে এখনি আলোকপাত করতে যাচ্ছিনা। তবে মোটা দাগে বলতে পারি এই জনপদে তিনি গোলাপের সৌরভ ছিটিয়েছেন। শরীরের অসংখ্য পাপড়ী ঝড়িয়ে অনেক অনেক গোলাপ জন্ম দিয়েছেন। এই মানুষটির হাত ধরে আজ  জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেকেই অধিষ্টিত। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক,  রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী ক্ষণজন্মা এই ব্যক্তিত্বকে বাহিরে রেখে সুনামগঞ্জের সাহিত্য সংস্কৃতির ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। অনেকেই বলেছেন আব্দুল হাই প্রতিভার মূল্যায়ন হতো তিনি যদি সুনামগঞ্জের মায়া কাটিয়ে রাজধানী মুখী হতেন। জাতীয়ভাবে পরিচিতি লাভের মেধা ও মনন ছিল তার। কিন্তু অনগ্রসর সুনামগঞ্জ থেকে তিনি বেরিয়ে যাননি-তার প্রিয় মাতৃভুমিকে আলোকিত করার জন্যই। সুনামগঞ্জবাসীর এমন এক ব্যক্তিত্বকে মূল্যায়নের সময় হলোনা । কবে হবে জানিনা।

লেখক- হুমায়ূন রশিদ চৌধূরী, ব্যুরো চীফ দৈনিক ইত্তেফাক, সিলেট, প্রতিনিধি বাংলাদেশ বেতার ও যুগ্ম সম্পাদক কমনওয়েলথ জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশন (সিজেএ) বাংলাদেশ চাপ্টার।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn