হাসান হামিদ-

আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ এমপি। তাঁকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি না, চিনি অন্য সবার মতোই। বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের নেতা তিনি। আমি অবাক হয়েছি তাঁর একটি বক্তব্যে। না, আমি রাজনীতি করি না; বা রাজনীতির নামে এদেশে যে চামচামি হয় তাঁর কর্মী নই। কিন্তু সোজা কথায় ইতিহাস এভাবে দলামোছা করতে চাইলে উত্তর পুরুষে তিনি কীসের উদাহরণ হবেন তা তো তাঁর না বোঝার কথা নয়! তিনি সম্প্রতি বলেছেন, জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, তিনি পাকবাহিনীর সাথে কখনো যুদ্ধ করেননি, জিয়াউর রহমান যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। গত বুধবার দুপুরে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে সদর উপজেলা আওয়ামীলীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। বলার আগে একবারও কি ভেবেছেন এটা কতো বড় মিথ্যাচার! তবে এ সংস্কৃতি নতুন নয়। কিন্তু এমনটি পেশাদার রাজনীতিবিদ হিসাবে, সত্যিকারের নেতা হলে কারও বলা উচিত নয়। শ্রদ্ধেয় মাহবুব উল আলম হানিফের তো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার কথা!

বেশি কথা বা ইচ্ছেমতো কথা বলে সীমা অতিক্রম করলে সেটা কিন্তু হিতে বিপরীত হয়। টেলিফোন আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের চাকর তার অনুপস্থিতিতে একবার পৃথিবীর প্রথম ফোনে কথা বলার চেষ্টা করেছিলো। আর তাতে তিনি রেগে গিয়ে তার এক মাসের বেতন কর্তন করেন। তারপর চাকর বেতন কাটার কারণ জানতে চায়।
-মনিব আমার অপরাধ ?
-তুমি সীমা অতিক্রম করেছ।
-কিসের সীমা ?
-কথা বলার সীমা।

কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ আর আমলাদের অতিকথনে সরকার বা দলের অবিভাবক মনে হয় শুনেও না না শোনার ভান করে থাকেন। বাজেট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও ব্যাংক হিসাবে আবগারি শুল্ক  বাড়ানোর বিষয়ে অনড় ছিলেন আমাদের অর্থমন্ত্রী। এ কারণে তার উদ্দেশ্যে সংসদে কয়েকদিন আগে ফজলুল করিম সেলিম বলেছিলেন, আপনি একগুঁয়েমি সিস্টেম বন্ধ করেন আর কথা কম বলেন। আসলেই কিন্তু অর্থমন্ত্রীর কিছু কথাবার্তায় সরকারকে অনেকবার  বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে; আর তা মোটেই শোভন নয়। অথচ এ ধরনের ঘটনা নিয়ে সমালোচনায় কেউ কেউ গোস্বা করেন মনে হয়।

আসলে এটা তো শুধু আমাদের বড় রাজনীতিবিদেরা নয়, তেল মারার রাজনীতির সংস্কৃতি এ দেশে একদিনে হয়নি; আগে থেকেই ছিল। স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশে যে যেভাবে পারছে তেল মেরেই যাচ্ছে। রাজনীতিবিদদের বলতে শুনি, তারা নাকি মুজিব আদর্শে রাজনীতি করেন। কিন্তু আমি তো জানি মুজিব হলো সেই শক্তির নাম, যে কোনোদিন অন্যায়ের সাথে আপোস করেনি। আর সারাজীবন ন্যায্য কথা বলা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকরা আজকাল তেলের পুকুর কেটে বসে আছেন। এসব তেলবাজদের খপ্পরে পড়ে আমাদের বাংলাদেশ কোথায় যাচ্ছে, আমরা একবারও কি ভাবি? তবে ইদানীং রাজনীতিবিদেরা, আমাদের এমপি মন্ত্রীরা কেউ কেউ যখন জনগণের পক্ষে কিছু বলেন, ভালো লাগে। সাধুবাদ জানাই যারা নিজেদের সমালোচনা করতে শিখেছেন তাদেরকে।কিন্তু মিথ্যাচার করলে খারাপ লাগে। এর নাম রাজনীতি? রাজনীতি মানে শুধু ভোটে জেতা আর দলের লাভ? রাজনীতি মানে জনগণের কিছু নয়? জনগণ এখন আগের মতো এতোখানি বোকা আছে কিনা তা পরিস্থিতি বলে দেবে। তবে দেশের বড় রাজনীতিবিদদের বলবো, দয়া করে নিজের লাভের কথা ভেবে রাজনীতিকে ব্যবসায় পরিণত করবেন না। কিছুদিন পর আপনারা ইতিহাসে বিকৃত এবং বিক্রিত চরিত্র হবেন। ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখবেন?

আর সব রাজনীতিবিদ একই কথা বলে উপরের সাহেবদের তেল মারে। মনে হয় সব কোর্স করা তেলবাজ। আর নখল করতে সবাই ওস্তাদ। এ বিষয়ে মজার একটি ঘটনা বলি। লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র তখন চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করছেন। তার নতুন একটা ছবি মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু ওই ছবির কাহিনী নিয়ে কথা উঠেছে। বুদ্ধদেব গুহ পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছেন যে, কাহিনীটি তার লেখা। প্রেমেন্দ্র মিত্র নাকি লেখাটি  নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন। সবাই উদগ্রীব, প্রেমেন্দ্র মিত্র এখন কী বলেন! কিন্তু প্রেমেন্দ্র মিত্র কিছু বলছেন না। কিছুদিন পর প্রেমেন্দ্র মিত্র বিবৃতি দিলেন। তিনি বললেন, ‘চলচ্চিত্রের কাহিনীটি আমার না সেটা সত্যি, তবে বুদ্ধদেব গুহ যেখান থেকে গল্পটি নিয়েছে, আমিও ওই একই জায়গা থেকে নিয়েছি।’

স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমানকে কেউ খাটো করে দেখলে ভাবতে হবে সে একজন মূর্খ, সে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস জানে না; অথবা জানে কিন্তু অস্বীকার করে। ইতিহাস বলে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।  আর আমাদের জাতির পিতা তাঁকে স্নেহ করতেন সে কারণেই। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তাঁর পরবর্তী সমালোচিত বা অন্য ভূমিকাও কিন্তু আমরা জানি। কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেননি সেটা তো ইতিহাস বলে না। এ ব্যাপারে আরও কয়েক লাইন বলি।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর বর্বরের মতো ঘৃণ্য হামলা চালায়। সে রাতে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বন্দী হন। বন্দী হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এরপর ২৭শে মার্চ জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করে শোনান। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় অবদান রাখেন। তিনি দলবল নিয়ে বেশ কয়েকদিন চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হন। ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে তিনি ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন। তিনি সেনা সদস্যদের সংগঠিত করে পরবর্তীতে তিনটি সেক্টরের সমন্বয়ে জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে যুদ্ধপরিচালনা করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমান, যুদ্ধ পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে ভুমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের জুন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ও তারপর জেড-ফোর্সের প্রধান হিসেবে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বের জন্য তাকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয়। রণাঙ্গনে তার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি সবসময় সামনে থাকতেন এবং কমান্ডারদের সৈনিকের সামনে থাকতে পরামর্শ দিতেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে তিনি যখন বিদ্রোহ ঘোষণার মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করলেন, তখন তিনি দেখলেন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যসংখ্যা মাত্র ৩শ’। তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক ছিলেন। মাত্র সাতজন অফিসার এবং ৩শ’ সৈন্য নিয়ে ছিল অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। এই স্বল্পসংখ্যক সৈন্য এবং অপ্রতুল অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তিনি প্রথমে তার বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এই বিদ্রোহ ছিল এক দুঃসাহসিক কাজ।

আমি তাই মনে করি, সম্মানিত রাজনীতির বরপুত্রগণ, সত্যি কথা বলুন। ভিন্ন পথ বা অন্য মতের হলেই তার সব খারাপ হয়ে যায় না। তাছাড়া একে অন্যকে আক্রমণ করে গলাবাজি বন্ধ করুন। মানুষ এখন এসব বুঝে। যৌক্তিক দোষগুলো সহজ করে জনগণের সামনে বলুন; গঠনমূলক সমালোচনা করুন। আর উপরের বাবুরা কথা কম বললেই ভালো হয়; বঙ্কিম চন্দ্রের সেই কথা তো সবাই জানা যে, অল্প কথায় কাজ হলে, বেশি কথার দরকার কি?

 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn