মাহমুদ আজহার-গুলশান এভিনিউয়ের ‘ফিরোজা’য় কেমন আছেন ৭৪ বছর ঊর্ধ্ব বেগম খালেদা জিয়া?- এমন প্রশ্ন দলীয় নেতা-কর্মীর পাশাপাশি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদেরও। সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পাওয়া বিএনপি-প্রধান এখন দৃশ্যমান রাজনীতিতে নেই। বক্তৃতা-বিবৃতি দিতেও মানা সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর। করোনাভাইরাসে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় শুধু ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও পরিবারের সদস্যরাই তাঁর সঙ্গে নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ করছেন। প্রয়োজনে দলের কাউকে ডেকে পাঠান বিএনপি-প্রধান নিজেই।

পারিবারিক ও দলীয় সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল। অস্টিও আর্থাইটিস, ডায়াবেটিসসহ অন্য সব রোগই বিদ্যমান। এখনো চলাফেরায় অন্যের সাহায্য নিতে হয়। জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা কমেনি। বাসায় দুজন নার্স স্থায়ীভাবে রাখা হয়েছে। তারা বাসায় থেকেই বেগম জিয়ার স্বাস্থ্যের সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছেন এবং ফিজিওথেরাপি দিচ্ছেন। এ ছাড়া তাঁর মেরুদ-, বাম হাত ও ঘাড়ের দিকে শক্ত হয়ে যায়। দুই হাঁটু প্রতিস্থাপন করা আছে। তিনি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ খান। বাম চোখেও একটু সমস্যা রয়েছে তাঁর।

বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রতিনিধিদলের একাধিক সদস্য জানান, প্রতিদিনই একজন চিকিৎসক ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ পরীক্ষা করেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দলও যান মাঝে-মধ্যে। ওষুধ খেয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন তিনি। এখন নিয়মিত ডায়াবেটিসের মাত্রা ৮ থেকে ১৪’র মধ্যে ওঠানামা করে। লন্ডন থেকে পুত্রবধূ, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সহধর্মিণী ডা. জোবায়দা রহমান বেগম জিয়ার চিকিৎসার সার্বিক তত্ত্বাবধান করছেন।

বিএনপি চেয়ারপারসনের সেজো বোন সেলিনা ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা এখনো স্বাভাবিক হয়নি। জেল থেকে এসেও শারীরিক তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। করোনাভাইরাসের কারণে উন্নত চিকিৎসাও করানো যাচ্ছে না। বাসায় থেকেই যতটুটু সম্ভব চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তাঁর শরীরের গিরায় গিরায় এখনো ব্যথা কমেনি। একা দাঁড়াতেও পারছেন না, হাঁটাচলাও করতে পারছেন না। বিছানা থেকে বাথরুমে যেতেও তাঁর অন্যের সহযোগিতা প্রয়োজন। এমনকি খাবার খেতেও কারও সহায়তা নিতে হয়। রুম থেকে ড্রয়িং রুমে বা রিডিং রুমে যেতেও সহায়তা লাগে। খাবারে কোনো সমস্যা নেই। স্বাভাবিক খাবারই খাচ্ছেন। যখন যেটা তাঁর পছন্দ তা-ই রান্না করে দেওয়া হয়।’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে আসা বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কারাবন্দী খালেদা জিয়া এখন ঘরবন্দী থাকলেও আগের চেয়ে শারীরিক অবস্থা অনেক ভালো। তিনি ঘরবন্দী হলেও এখন মুক্ত। তবে তাঁর উন্নত চিকিৎসা জরুরি। কিছু চিকিৎসা আছে যেটা তিনি লন্ডনে করান। সেখানে করাতে পারলেই ভালো হতো। কিন্তু বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে তা সম্ভব নয়। জানা যায়, অসুস্থ খালেদা জিয়ার এখন অবসর সময়ও অনেক। অবসরে দীর্ঘ সময় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকা পড়েন তিনি। মূলধারার সব পত্রিকাই তাঁর বাসভবনে বান্ডিল করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পত্রিকা পড়ে দলকে কোনো দিকনির্দেশনা দেওয়ার থাকলে কারও মাধ্যমে বার্তা পাঠান। বেসরকারি টেলিভিশনের খবরাখবর দেখেও সময় কাটান তিনি। এ ছাড়া লন্ডনে থাকা বড় ছেলে তারেক রহমান, দুই পুত্রবধু ও নাতনিদের সঙ্গে ফোনে কথাবার্তা বলেও সময় কাটান তিনি। এ ছাড়া মাঝে-মধ্যে বড় ভাই মরহুম সাইদ এস্কান্দারের পরিবার, ছোট ভাই শামীম এস্কান্দারের পরিবার, সেজো বোন সেলিনা ইসলাম ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও বাসায় কথাবার্তা বলে সময় কাটে বেগম জিয়ার। জরুরি কোনো প্রয়োজন হলে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বা আইনজীবী কোনো নেতাকে তিনি ডেকে পাঠান। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, বাসায় সাধারণ খাবারই খাচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া। তবে ডায়াবেটিস থাকায় সতর্কভাবে খাবার খান তিনি। তাঁর পছন্দের খাবার হচ্ছে স্যুপ, সবজি-রুটি, মুরগি, লাউ ও মাছের ঝোলের তরকারি। মাঝে-মধ্যে সরু চালের ভাত ও পোলাও খান তিনি। তাঁর বাসায় পুরনো বাবুর্চিরাই রয়েছেন। অনেক সময় পরিবারের সদস্যরা বাসা থেকে রান্না করেও খাবার নিয়ে আসেন।  বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক দলের সিনিয়র সদস্য ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) শারীরিক অবস্থা আগের মতোই। ডায়াবেটিস এখনো ওঠানামা করে। আগে জয়েন্টে জয়েন্টে যে ব্যথা ছিল সেগুলো এখনো আছে। তিনি আগের মতো হাঁটাচলা করতে পারেন না। কাউকে ধরে হাঁটাহাটি করতে হয়। তাঁর চিকিৎসা সার্বিকভাবে তদারকি করছেন তাঁর পুত্রবধূ ডা. জোবায়দা রহমান। আমরাও সহযোগিতা করছি।’  সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বেগম জিয়ার ঘুম খুবই কম হয়। দীর্ঘ রাত জাগেন তিনি। বেগম জিয়া পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। নিয়মিত কোরআন শরিফ তিলাওয়াত ও অজিফা পড়েন। প্রায় সারা দিনই পত্রিকা পড়েন। টিভির নিউজ দেখেন। রাত জাগার আরেকটি কারণ হলো, তিনি লন্ডনের সময় অনুযায়ী মধ্যরাতে নাতনিদের সঙ্গে কথা বলেন। না ডাকলে দলের কেউ যান না তাঁর বাসভবনে। মেডিকেল টিমও যাচ্ছে মাঝে-মধ্যে। নিয়মিত ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেসার ও ভিটামিনযুক্ত ওষুধ সেবন করেন। সার্বিক বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বেগম খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করা হয়েছে। সাজা স্থগিত হলে তো তাঁর ওপর কোনো বিধিনিষেধ থাকার কথা না। পার্থক্যটা হচ্ছে, শুধু হাসপাতাল থেকে তাঁকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। ওখানে তিনি হোমলি পরিবেশের মধ্যে আছেন। যেটাকে সোজা কথায় বলা যায়- এটা হচ্ছে গৃহে অন্তরীণ করা। অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্ট তো এখানে হচ্ছে না। তাঁর উন্নত চিকিৎসা জরুরি।’

লন্ডনে পাঠানোর প্রক্রিয়া স্থগিত : উন্নত চিকিৎসার জন্য কিছুদিন আগেও খালেদা জিয়াকে লন্ডনে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। বর্তমানে সেই উদ্যোগ স্থগিত আছে বলে জানা যায়। অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের জন্য সরকার ও পরিবারের সমঝোতার মাধ্যমে বেগম জিয়াকে লন্ডনে পাঠানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়। কূটনৈতিক মহলও এ নিয়ে উদ্যোগী হয়। সরকার অনুমতি দিলে ব্রিটিশ হাইকমিশন বেগম জিয়ার চিকিৎসার জন্য ভিসা দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসন বলেন, সরকার অনুমতি দিলে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য তারা ব্রিটেন যেতে ভিসা দেবেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ জন্য ব্রিটিশ সরকার ও হাইকমিশনারকে ধন্যবাদও জানান। কিন্তু হঠাৎ এ প্রক্রিয়া থেমে যায়। এখন বিএনপি ও পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ দিন দিন বাড়ছেই। লন্ডন ও বাংলাদেশের অবস্থা ভালো নয়। এ জন্য বেগম জিয়া নিজেও লন্ডনে যেতে আগ্রহী নন। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানা গেছে।

উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে পাঠানো সম্পর্কে খালেদা জিয়ার বোন সেলিনা ইসলাম বলেন, ‘সেখানে কীভাবে পাঠাব? সেখানেও তো করোনার অবস্থা ভয়াবহ। এখনো লকডাউন চলছে। কেউ যেতেও পারছে না। আবার আসতেও পারছে না। দুই দেশের করোনা পরিস্থিতি উন্নত হলে দেশের বাইরে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো যায় কিনা তা চিন্তাভাবনা করা হবে।’ ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের সাজায় কারাজীবন শুরু করেন খালেদা জিয়া। পরে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায়ও তাঁর সাজার রায় হয়। তাঁর বিরুদ্ধে আরও ৩৪টি মামলা রয়েছে। ২৫ মাসেরও বেশি সময় কারাবন্দী থাকার পর চলতি বছরের ২৫ মার্চ খালেদা জিয়া করোনাকালে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘মানবিক বিবেচনায়’ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি পান। এরপর আরও এক দফায় তাঁর জামিনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। তারপর থেকে তিনি গুলশানের বাসা ‘ফিরোজায়’ রয়েছেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn