মারুফ খান মুন্না :: ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় ধানের শীষ’ এরকম স্লোগান আপনি হয়তো -দেশ স্বাধীনের পরবর্তী সময় থেকে ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনের কয়েকদিন আগ পর্যন্ত- রুপকথার গল্পেও শুনবেন এমনটি কল্পনা করেননি। মুজিব কোর্ট গায়ে দিয়ে মুজিবাদর্শের রাজপথ কাপানো সৈনিকই যখন ‘জয় বাংলা, জয় ধানের শীষ’ বলে স্লোগান দেয় কেমন যেনো ‘ঘোলাটে’  লাগে। তবে মুদ্রার উল্টো পিঠও আছে। একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা, দলটির ভাইস চেয়ারপার্সন কিংবা কেন্দ্রীয় নেতারা যখন রাজনৈতিক প্রধান বিরোধী দলের সভানেত্রীর হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে দলবদল করে তখন ‘ক্ষমতার লোভ’ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। আর ক্ষমতার লোভে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের দলবদলের খেলায় সারাদেশে যেনো এগিয়ে সিলেট।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্টিত দল বিএনপির প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয়, ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম, ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ ও ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদে ছিল সরকারি দল। ২০০১ সালের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর সংসদে প্রধান বিরোধী দল ছিলো বিএনপি। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে এমনকি সংসদের বাইরে থাকায় দলটির নেতাকর্মীরা ক্ষমতায় যেতে উদগ্রীব ছিলো। আর তাই গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়ে সিলেটসহ সারাদেশের অনেক বিএনপির নেতাকর্মীই যোগ দিয়েছেন আওয়ামী লীগে।
তবে স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মী নয় বরং জাতীয় পর্যায়ের কেন্দ্রীয় অনেক নেতার আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে এবং বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় চলছে। এরকম দলবদলের খেলায় সারাদেশে খোরাক যোগাচ্ছে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের সিলেটের একাধিক নেতৃবৃন্দের দলবদলের খবরে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন- কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক  সুলতান মো. মনসুর (আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট জোটে), বিএনপি’র সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমশের মবীন চৌধুরী (বিএনপি থেকে আওয়ামী জোট বিকল্পধারায়), বিএনপি’র সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও দলটির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ইনাম আহমদ চৌধুরী (বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে), বিএনপির সাবেক এমপি এম এম শাহীন (বিএনপি থেকে আওয়ামী জোট বিকল্পধারায়)।
এদের মধ্যে বিগত নির্বাচনে সাবেক আপাদমস্তক আওয়ামী লীগার সুলতান মো. মনসুর ধানের শীষ এবং  এম এম শাহীন নৌকা প্রতিক নিয়ে নির্বাচনেও লড়েছেন। শমশের মবীন চৌধুরী নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করতে চেয়েও মনোয়নয়ন পাননি। আর ইনাম আহমদ চৌধুরী ধানের শীষে চূড়ান্ত মনোনয়ন না পেয়ে দলই বদলে ফেলেন। এমনকি তিনি নির্বাচনে নৌকার মাঝি সিলেট-১ আসনের আওয়ামী প্রার্থী ড.একে আব্দুল মোমেনের পক্ষে চালান প্রচারণা। এদিকে, বিএনপি ছেড়ে ঠানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসা দল আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছেন বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় পর্যায়ের সিলেটী নেতা- এমন গুঞ্জনও ছড়িয়ে পড়েছে সিলেটের গন্ডি ছেড়ে সারাদেশে। এক্ষেত্রে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সদস্য সাবেক এমপি এবং একাদশ নির্বাচনে ধানের শীষ নিয়ে সিলেট-৩ আসনের প্রার্থী শফি আহমদের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলছেন খোদ দলীয় নেতাকর্মীরা। এ তো গেলো কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীদের দলবদলের কাহিনী। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি ও আওয়ামী লীগের জয়রথে সারাদেশের স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপিসহ অন্যান্য দল থেকে আওয়ামী লীগের যোগদানের হিড়িক পড়েছে। এদিক থেকেও পিছিয়ে নেই সিলেট। কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি সিলেটের তৃণমূল ও স্থানীয় পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতাকর্মীদের দলবদলের ঘটনা ঘটছে অহরহ। বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীসহ বিএনপি মনোভাবাপন্ন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান যোগ দিচ্ছেন আওয়ামী লীগে।
সিলেট জেলা বিএনপির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের দুই মেয়াদের চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিম চৌধুরী, দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বরইকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিব হোসেন, বালাগঞ্জ উপজেলার দেওয়ান বাজার ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আফম শামীম , দেওয়ান আব্দুর রহিম হাইস্কুল এর কলেজ গভর্ণিংবডির সদস্য এনায়েতুর রহমান রাজুসহ সিলেট বিভাগের জেলা, মহানগর, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ইউনিটের পদবীধারী বিএনপি নেতাও যোগ দিচ্ছেন আওয়ামী লীগে কিংবা ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন নব নির্বাচিত আওয়ামী সাংসদকে। দলবদলের রাজনীতিতে তালিকায় ঠানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নাম নেই বললেই চলে। তবে ক্ষমতার দাপট খাটাতে এবং প্রভাব বিস্তার করতে বিএনপিসহ অন্যন্যদল থেকে আওয়ামী লীগে যোগদানের সংখ্যা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। আওয়ামী রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট অনেকেই বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন না। কেননা তারা মনে করেন, এই উড়ে এসে জুড়ে বসা অন্য দলের নেতাকর্মীদের জন্য দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়া সহ তৃণমূলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা দলীয় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারে।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn