রাজীব রাসেল-

এবছর একুশে পদক পেয়েছেন সিলেটের প্রবীন লোকসঙ্গীত শিল্পী সুষমা দাস। নিজের দীর্ঘ সঙ্গীত জীবন, বৈরি পরিবেশে সঙ্গীত চর্চা, সাম্প্রতিক সময়ে লোকগানের চর্চা, একুশে পদক প্রাপ্তি- এসব বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে (৮ মার্চ) নিজ বাসায় সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম’র সাথে কথা বলেন তিনি। তার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো-
আপনার সঙ্গীত চর্চার শুরু কিভাবে?
: খুব ছোটবেলা থেকেই আমি সঙ্গীতের সাথে জড়িত। ৭ বছর বয়স থেকে গান করি। আমাদের বাড়িতে গান-বাজনার পরিবেশ ছিলো। গানের প্রতি তখন থেকেই পাগল ছিলাম। খাবার না খেলে আমার চলতো, কিন্তু গান ছাড়া আমি থাকতে পারতাম না। গানই আমার জীবন, গানই আমার সব। গানের মধ্যে থাকলেই আমি সুস্থ্য থাকি, আমার শরীর ভালো থাকে। ১৬ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়েছিলো। কিন্তু গান ছাড়িনি। সংসার করেছি, গানও করেছি।
সেই সময়ে সঙ্গীত চর্চায় কোনো সমস্যা বা বাধার মুখে পড়তে হয়েছিলো?
: সমস্যা তো ছিলোই। এখন তো আমার ঘরেই তবলা আছে, হারমোনিয়াম আছে। আগে এমন ছিলো না। তিন/চার পাড়া খুঁজে একটা হারমোনিয়াম পাওয়া যেতো না। অনেক কষ্টে আমরা গান করেছি। একটু বড় হওয়ার পর গান গাওয়া নিয়ে কটু কথাও শুনেছি। কেউ কেউ বলতো- মেয়ে মানুষ গান করবে কেন? কিন্তু এসব বাধার পরেও সঙ্গীত চর্চা থামাইনি।
এই বাধা অতিক্রম করলেন কিভাবে?
: আমি আমার বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। আমার পরে এক বোন আর তাঁর পরে রামকানাই দাশ। রামকানাই আমার সাত বছরের ছোট। বাবা আমাদের খুবই আদর করতেন। তিনি কোন কিছুতে আপত্তি করেননি। আর গান গাওয়ার ক্ষেত্রে আমার কোন লজ্জা-শরম ছিলো না। কেউ কেউ বাবাকে বলতো- ‘মেয়েকে তো তুমি নষ্ট করে ফেলছো! পুরুষ মানুষের সামনে চিৎকার করে গান গায়!’ কিন্তু আমি ছিলাম গান পাগল। গান গাওয়া বন্ধ করিনি।
কোন ধরণের গান আপনি বেশি গেয়েছেন?
: আমি পল্লী গান গেয়েছি, বাউল গান গেয়েছি, কবি গান গেয়েছি। শুধু ঘাটু গান গাওয়া হয়নি। পল্লী গান তো আমার সম্পদ। আর কবি গান বলতে দুই শিল্পীর মধ্যে কবির লড়াই বা মালজোড়া গান না কিন্তু। আমাদের কবি গানে ২০-৩০ জন পাটি পেতে বসতো। একজন গানে গানে প্রশ্ন করতো, আরেকজন গানে গানে জবাব দিতো। অনেক সময় একা একাও গাইতাম কবি গান। ভালো লাগতো। বাবার সঙ্গে সঙ্গে গান করতাম। তারপর আমার বিয়ে হয়ে গেলো। সংসার করার সঙ্গে সঙ্গে গানও চালিয়ে গেছি।
আপনার গাওয়া গানগুলো কি কোথাও লিপিবদ্ধ করা আছে?
: আমি কলম দিয়ে একটি গানও লিখিনি। হাজারের ওপর গান গেয়েছি। গান শুনে শুনে মাথায় ঢুকিয়ে নিতাম, তারপর গাইতে গাইতে গলায় গান তুলতাম। লেখা নেই বলে আমার গান কখনো চুরিও হবে না। একমাত্র আমি মরে গেলেই গানগুলো আর থাকবে না। আমার গান মাথার ভেতরে। তিন-চারশ’ গান আমার মুখস্থ।
পরবর্তী প্রজন্ম যদি আপনার গান গাইতে চায়, তাঁরা এই গানগুলো কিভাবে পাবে?
: আমার ছেলে আমার গান চর্চা করে। ছোট ছোট নাতি-নাতনিরাও এখন আমার গান গাইছে। এভাবেই তাদের মাধ্যমে গানগুলো বেঁচে থাকবে। আমি আমার ছেলেকে বলেছি, সপ্তাহে ১/২টা করে হলেও যেন আমার গান কোথাও লিখে রাখে। ১/২টা করে গান লিখলেও মাসে ৮টা গান লেখা হয়ে যাবে। সেও লিখতে শুরু করেছে।
গানগুলো নিয়ে কোনো বই প্রকাশ করার ইচ্ছা বা পরিকল্পনা আপনার আছে?
: এটা আমার ছেলেরা যদি করে, তাহলে করুক। আমার তো এখন এসব করার বয়স নেই। তারা এসব ভাববে।

আপনার সঙ্গীত চর্চা শুরুর সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার তেমন সুযোগ ছিলো না। আপনি গান গাওয়া শিখলেন কিভাবে?
: প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ আগে ছিলো না। আমরা গান করেছি লোকগীতি। লোকের মুখে মুখে গান শুনেছি, গান শিখেছি। তৎকালে তেমন গীতিকার ছিলেন না। আমরা শুধু রাধারমণের গান পেয়েছি। তাঁর গানই বেশি গেয়েছি। এরপর পেয়েছি রামজয় সরকারের গান। রামজয় সরকারের গান মুখে মুখে শিখেছি, গেয়েছি। আরও গেয়েছি শ্রী দুর্গা প্রসাদের লেখা গান। শ্যামসুন্দরের লেখা গান গেয়েছি। এরপর তো ছিলেন আমাদের করিম ভাই (বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম)। করিম ভাইয়ের গান মুখে মুখে শুনেছি, গেয়েছি। গান শেখার জায়গা ছিলো না। পরিবার থেকে গান শিখেছি। এছাড়া গ্রামের মানুষ গান গাইতো, সেগুলো শুনে শুনে শিখেছি। কারো মুখে কোন গানের একটা অন্তরা শুনলে মনে হতো এর পরের অন্তরা কি হবে? সেই ভাবনা থেকে নিজেই অন্তরা বানিয়ে গাইতাম। গুরুদয়াল সূত্রধর নামে একজন তখন খুব ভালো গান করতেন। বর্ষাকালে আমাদের গ্রামে এসে গানের আসর করতেন। আমরা তাঁর গান শুনতাম, শিখতাম। চাঁদনী রাতে উঠানে বসতো গানের আসর। অনেক মানুষ আসতো গান শুনতে। ওই সময়ে শোনা গান আমি এখনো মনে করে গাইতে পারি।
এখনকার শিল্পীরাও আপনাদের সময়ের গান গাইছেন। তাঁরা কেমন গাইছেন বলে আপনার মনে হয়? আপনি কি সন্তুষ্ট?
: আমরা চেয়েছি রাধারমণের মতো মানুষকে যোগ্য উচ্চতায় রাখতে। এখন যে শিল্পীরা গান করেন, তা তাদের ব্যক্তিগত। যা মনে আসে, তাঁরা তাই গাইছেন। গানের কথাও ব্যতিক্রম করে, সুরও ব্যতিক্রম করে। যেমন ধরো, এখনকার শিল্পীরা গাইতে শুনি- ‘ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া …’। এই কথাটা ভুল। ভাইবে শব্দের মানেই ভাবিয়া। পরে ‘মনেতে ভাবিয়া’ বলার দরকার নেই। এটা আসল গানেও নেই। অনেক শিল্পী নিজের ইচ্ছামতো কথা বসিয়ে দিয়ে এসব গান গাইছে।
এখন তো আগেকার গানে অনেক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। নতুনভাবে গাওয়া হচ্ছে সেই গানগুলো। নতুন সঙ্গীতায়োজনে করা সেই গানগুলো আপনার কেমন লাগে?
: আগে বাদ্যযন্ত্র বলতে শুধু হারমোনিয়াম আর খোল ছিলো। এখন তো কতো বাদ্যযন্ত্র। ঢোল, তবলা, বেহালা দিয়ে গান গাওয়া হচ্ছে। আমরা স্কেল মিলিয়ে গান গাইতে পারিনি। এখন এই সুযোগ বেশি। কিন্তু এতো বাদ্যযন্ত্র, এতো সুযোগ থাকার পরেও কেন গান বিকৃত হচ্ছে আমি বুঝি না। একটা ঘটনা বলি, একবার সিলেটের কবি নজরুল অডিটোরিয়ামে একটা গানের অনুষ্ঠান হলো। আমি বসে গান শুনছিলাম। ঢাকা থেকে আসা শিল্পী বাউল শাহ আব্দুল করিমের একটা গান গাইতে গাইতে শেষ করলেন এভাবে গেয়ে ‘ভাইবে রাধারমণ বলে …’! অথচ এই কথা ব্যবহার হয় রাধারমণের গানে।
এর কি কোনো প্রতিকার করা সম্ভব? আপনার মত কি?
: প্রতিকার দরকার। এই প্রজন্মের শিল্পীরা ভালো শিক্ষকের কাছে গান শেখা উচিত। তাদের কাছে আমার অনুরোধ- বুঝে, শিখে গান গাও। গানের গীতিকারের নামটা ঠিক রাখো। সুন্দর গান গাও।
কার গান আপনি সবচেয়ে বেশি গেয়েছেন?
: আমি রাধারমণ দত্তের গান বেশি গেয়েছি। এছাড়া শাহ আব্দুল করিমের গানও গেয়েছি।
শাহ আব্দুল করিমের সঙ্গে আপনার অনেকবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। একসাথে গানও গেয়েছেন। তাঁর সঙ্গে বিশেষ কোনো স্মৃতির কথা বলবেন?
: করিম ভাই তখন খুব অসুস্থ। ১৬ দিন ধরে বিছানায়। চোখ খুলেন না, কথা বলেন না। আমি দেখতে গিয়ে তাঁর গায়ে হাত দিয়ে ডাকলাম- ‘করিম ভাই, ওঠো। আমি তোমার সুষমা দিদি। ও করিম ভাই।’ করিম ভাই তখন চোখ খুলে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলাম- ‘আমাকে চিনতে পেরেছো?’ তিনি মাথা নেড়ে জানালেন চিনতে পেরেছেন। এটাই তাঁর সাথে আমার সবচেয়ে বড় স্মৃতি।
সঙ্গীতে অবদানের জন্য আপনি এবার একুশে পদক পেয়েছেন। এই স্বীকৃতি পেয়ে আপনার কেমন লাগছে?
: এটা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। পুরষ্কারটা আমাকে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই। আমি সারাজীবন গানের সাধনা করে গেছি। গানই আমার সব। এখনও কেউ গানের জন্য ডাকলে সব ফেলে আমি গান গাইতে ছুটে যাবো।
পুরষ্কার নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে। সেই সময় তাঁর সাথে আপনার কোনো কথা হলো?
: সেই অনুষ্ঠানে (একুশে পদক প্রদান অনুষ্ঠান) অনেক মানুষ ছিলো। তেমন কথা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শুধু আমায় জিজ্ঞেস করলেন- ‘আপনার শরীর ভালো?’ আমি বললাম- ‘ভালো আছি।’ এই যে প্রধানমন্ত্রী আমার খবর জানতে চাইলেন, তাতেই আমি ধন্য।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn