বাংলাদেশের মাদক বিরোধী অভিযানকে ফিলিপাইনের মতো বলে বর্ণনা করেছে বৃটিশ সংবাদ মাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান। অনলাইন দ্য গার্ডিয়ানের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইতিমধ্যেই মাদকবিরোধী অভিযানে নিহত কয়েকজনকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একজনের পরিবার দাবি করেছেন, তার নিহত স্বজন বিরোধীদলের কর্মী ছিলেন। তিনি কখনোই মাদক ছুঁয়ে দেখেন নি। এই পরিবারসহ আরো কয়েকটি পরিবার বলেছে, মৃতদেহ উদ্ধারের কয়েক ঘণ্টা আগে এসব মানুষকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এরপর যা ঘটে, কর্তৃপক্ষ তাকে রাত্রিকালীন বন্দুকযুদ্ধ বলে উল্লেখ করছে। অবৈধ মাদকের রমরমা ব্যবসা, বিশেষত মেথামফেটামাইন বা ইয়াবার ব্যবসা বন্ধ করতে গত সপ্তাহে বাংলাদেশ এই অভিযান শুরু করে। উত্তেজনা সৃষ্টিকারী এই মাদক সাধারণত প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, গত বছরে ৩০ কোটি ইয়াবার পিল বাংলাদেশে পাচার করা হয়েছে। এর জন্য রাখাইনে সেনাবাহিনীর নির্যাতনে পলায়নপর রোহিঙ্গা শরণার্থী ও তাদের বহন করে বাংলাদেশে নিয়ে আসা জেলেদের দায়ী করা হয়েছে।
গত সপ্তাহে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকেই প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকালে ৯ মাদক ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হয়। এতে ১০ দিনে মৃতের সংখ্যা ৫২ জনে পৌঁছায়। নিহতদের মধ্যে একজনের নাম আমজাদ হোসেন। পুলিশ বলছে, তাকে নিয়ে পুলিশ নেত্রোকোনার একটি মাদকের আস্তানায় অভিযান চালায়। এ সময় মাদক ব্যবসায়ীরা পুলিশ কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হলে আমজাদ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। নেত্রকোনা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশরাফুল আলম বলেন, তার বিরুদ্ধে হত্যা, সহিংসতা ও মাদক সংক্রান্ত ১৪টি মামলা রয়েছে। সম্প্রতি গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার করি। পরে তার সহযোগীরা আমাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এসময় সে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। তবে আমজাদের ভাই মাহিদ আহমেদ আনসারি বলেন, আমজাদ মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের কয়েক ঘণ্টা আগে পুলিশ তাদের বাড়িতে অভিযান চালায়। হঠাৎ চালানো এই অভিযানে আমার ভাইকে ব্যাপক মারধর করা হয়। তার বিরুদ্ধে মাদক বিক্রির অভিযোগ পুরোপুরি ভিত্তিহীন। তাকে হত্যা করা হয়েছে শুধু এ কারণে যে, সে বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠনের একজন জনপ্রিয় কর্মী ছিল। তিনি বলেন, আমজাদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো এ বছরের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচন উপলক্ষে বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক কর্মীদের উদ্দেশ্যমূলক হয়রানির অংশ। গার্ডিয়ান আরো লিখেছে, অনেক অভিযান র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটলিয়ান (র‌্যাব) দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। র‌্যাবের অভিযানে শুক্কুর আলী নিহত হয়। র‌্যাবের দাবি, শুকুর কুখ্যাত ইয়াবা ও ভাং ব্যবসায়ী। তার বিরুদ্ধে অন্তত ১০টি মামলা রয়েছে। র‌্যাবের বিবৃতি অনুযায়ী, র‌্যাব কর্মকর্তারা চট্টগ্রামের একটি মাদকের আস্তানায় অভিযান চালায়। এ সময় তারা সশস্ত্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। উভয়পক্ষের গুলিবিনিময় শেষে ঘটনাস্থল থেকে শুকুরকে মৃত উদ্ধার করা হয়। তার অন্য সহযোগীরা পালিয়ে যায়।
কিন্তু শুকুরের স্বজনরা বলছেন, সোমবার মধ্যরাতের পর সাদা পোশাকে কয়েকজন ব্যক্তি তার বাড়িতে এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়। নিহতের জামাই মোহাম্মদ সোহেল বলেন, কিছুক্ষণ পরই আমরা গুলির শব্দ শুনতে পাই। বাইরে এসে কিছুটা দূরে শ্বশুরকে পড়ে থাকতে দেখি। এটা পরিষ্কার যে, যারা তুলে নিয়ে গেছে, তারাই তাকে গুলি করে হত্যা করেছে। এটা সত্য না যে, তিনি মাদকের আস্তানায় ছিলেন। সেখানে গুলিবিদ্ধ হন। তিনি মাদক নিতেন। কিন্তু এটা সত্য না যে তিনি মাদক বিক্রি করতেন। ঢাকাভিত্তিক মানবাধিকার কর্মী পিনাকি ভট্টাচার্য বলেন, পুলিশের গুলি করে হত্যা করার উন্মত্ততা দেশজুড়ে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এগুলো পরিষ্কারভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যা। যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এসব বাহিনীর অবাধ ক্ষমতা আছে। তারা বিচারক ও জল্লাদের ভূমিকা পালন করছে। এ ছাড়া মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, এসব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেছেন, একজন মন্ত্রী তো মাদকাসক্তদের গুলি করার কথা বলেছেন। আর প্রধানমন্ত্রী এটাকে ইসলামী উগ্রপন্থিদের নিধনের প্রচেষ্টার সঙ্গে তুলনা করেছেন। নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা যথাযথ জবাবদিহিতা ও নজরদারি ছাড়াই আরো একবার তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, যা উদ্বেগের বিষয়।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn