এমএ কাউসার- চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে মৃত্যু ঠেকাতে প্রতিবছরই বর্ষার শুরুতে নানা কর্মসূচি নেয়া হয়। কোনো উদ্যোগই যেন কাজে আসছে না। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি সরাতে ব্যর্থ হচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। জেলা প্রশাসনের পর খোদ ত্রাণমন্ত্রীর হুশিয়ারির পরও পাহাড় থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরানো যায়নি। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি দলের নেতা ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা নগরীর অধিকাংশ পাহাড় দখল করে এর পাদদেশে অবৈধভাবে গড়ে তুলেছে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি। শত শত বাসাবাড়ি তৈরি করে ভাড়া দিয়ে এবং দখলস্বত্ব বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় মৃত্যুঝুঁকি নিয়েও পাহাড়ের পাদদেশে নির্মিত খুপরিতে ভাড়ায় থাকছে দরিদ্র ও নিু আয়ের মানুষ। মূলত সরকারি দলের নেতা ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের দাপটে সরানো যাচ্ছে না পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের। ফলে প্রতিবছরের মতো এবারও বর্ষায় টানা বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে প্রাণহানির আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা। নগরীর বিভিন্ন পাহাড়ের লক্ষাধিক মানুষ এখনও ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, গত বছর কয়েকদিনের টানা বর্ষণে পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে ১৩০ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে রাঙ্গামাটিতে সেনা কর্মকর্তাসহ ৯৮ জন, বান্দরবানে ৭ জন এবং চট্টগ্রামে ২৫ জন মারা যান। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে টানা বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে দুর্ঘটনা এবং মৃত্যু ঠেকাতে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ, গ্যাস-পানি, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। তবে সরকারদলীয় নেতা ও প্রভাবশালীরা এসব অবৈধ বসতির নিয়ন্ত্রণে থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটরা উচ্ছেদ কার্যক্রম চালাতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন। এবারও ১৫ এপ্রিলের মধ্যে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ করার জন্য নির্দেশনা দেয় জেলা প্রশাসন। বেধে দেয়া সময়ের মধ্যে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো থেকে অবৈধ বসতি সরাতে পারেনি তারা। উচ্ছেদ কার্যক্রম চালাতে গিয়েও অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের বাধার মুখে ফিরে আসে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের সম্মেলন কক্ষে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ১৮তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান জানান, ওই সভায় পাহাড় থেকে অবৈধ বসতি সরাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে প্রশাসন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২২ এপ্রিল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে ‘পাহাড় ধস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি ও আগাম সতর্কতা’ শীর্ষক কর্মশালা ও নগরীতে র‌্যালি বের করা হয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেনের সভাপতিত্বে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শাহ কামাল, অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মহসিন, যুগ্মসচিব মো. হিরুজ্জামানসহ চট্টগ্রাম পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। এ কর্মশালায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, পাহাড় ধসে আর একটি মৃত্যুও দেখতে চাই না। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসতির নিয়ন্ত্রকরা যত বড় শক্তিশালীই হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। ১৫ মে’র মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ করতে হবে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে উচ্ছেদের মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাদের সর্বাÍক সহযোগিতা করবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাহাড়ের পাদদেশে নতুনভাবে বাড়িঘর বানিয়ে বসবাস শুরু হয়েছে পুরোদমে। টাইগারপাস এলাকার ট্রাফিক পুলিশ বক্সের পেছনের পাহাড়ের নিচে আবারও প্রায় অর্ধশত পরিবার ঘর বানিয়ে বসবাস করছেন। বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে বাঁশের মাচার ছাউনির উপরে পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এসব ঘরের সঙ্গে তৈরি করা হয়েছে অস্থায়ী ল্যাট্রিন ও গোসলখানা। বসবাসকারীরা খাবারের পানি সংগ্রহ করছেন পার্শ্ববর্তী রেলওয়ে কলোনি থেকে। বৃহত্তর চট্টগ্রামে পাহাড়ের পাদদেশে ঠিক কতজন মানুষ বা পরিবার বসবাস করছে, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই প্রশাসনের কাছে। তবে জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, নগরীর ১৮টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৬৮৪টি পরিবার বসবাস করছে। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা অনেক বেশি। নগরীর অর্ধশতাধিক পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে লক্ষাধিক মানুষ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস করছে মতিঝর্ণা পাহাড়, আকবর শাহ পাহাড় ও বায়েজিদ বোস্তামি থানা এলাকার বিভিন্ন পাহাড়ে। বসবাসকারীদের মতে, শহর অঞ্চলে পাহাড়ের পাদদেশে তৈরি করা ঝুঁকিপূর্ণ বস্তি ঘরে কম টাকায় থাকতে পারে শ্রমজীবী লোকজন। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগও সহজে মেলে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বেশকিছু পরিবারকে এরই মধ্যে সরানো হয়েছে। তবে যারা এখনও পর্যন্ত সরেনি তাদের উচ্ছেদ করা হবে। উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে কী পরিমাণ পরিবার সরানো হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn