ছাতকে অবস্থিত লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানার ক্ষতিকর বর্জ্য ও ধুলোবালিতে নষ্ট হচ্ছে সেখানকার পরিবেশ ও ফসলি জমি। ভারত থেকে আনা চুনাপাথর সনাতন পদ্ধতিতে আনলোডের কারণে কারখানার আশপাশে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় ক্ষতিকারক ধুলোবালি ছড়িয়ে পড়ছে। এ কারণে লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানার বিরুদ্ধে স্থানীয়রা পরিবেশ দূষণসহ বিভিন্ন অভিযোগ করে আসছেন ১১ বছর ধরে। কিন্তু কোনো প্রতিকার মেলেনি। সেখানে কারখানাটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পরিবেশ দূষণ ও ফসলি জমি ধ্বংসের মতো একাধিক অভিযোগ সরকারের বিভিন্ন দফতরে দেয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকরা।

বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, ফসলি জমি নষ্ট, নদীশাসনসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে লাফার্জের বিরুদ্ধে। এছাড়া পাহাড়সম মাটি ডাম্পিংয়ের ফলে আশপাশের বসতবাড়িতে ফাটল, গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণ ও সবুজ পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এসব অভিযোগ সরকারের উচ্চপর্যায়ে পৌঁছার আগেই লাফার্জের উপকারভোগী একটি মহল বিষয়টি কৌশলে দমিয়ে রাখছে বলে এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন অভিযোগ করেছেন।

এশিয়ার সর্ববৃহৎ ক্লিংকার ও সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানা ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সুরমা নদীর তীরে। ২৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগে ফ্রান্সের অত্যাধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক বার্ষিক ১ দশমিক ২ মিলিয়ন টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এ কারখানাটি শহরের সুরমা নদীর উত্তর পাড় টেংগারগাঁও ও নোয়ারাই গ্রামের মাঝামাঝি এলাকায় স্থাপিত। কারখানার প্রধান কাঁচামাল চুনাপাথর সংগ্রহের জন্য ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পূর্ব খাসিয়া বনভূমি এলাকার ১১৬ হেক্টর খনিজাত ভূমি আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে লিজ গ্রহণ করে লাফার্জ। ভারতের খনি প্রকল্প থেকে লাফার্জের অভ্যন্তরে ১৭ কিলোমিটার সংক্রিয় কনভেয়ার বেল্টের মাধ্যমে চুনাপাথর পরিবহন করা হচ্ছে প্রতিষ্ঠার পর থেকে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে। কিন্তু কারখানাটি উৎপাদনে যাওয়ার ছয় মাসের মাথায় পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে ভারত থেকে চুনাপাথর আমদানিতে সে দেশের উচ্চ আদালত নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

ফলে কারখানাটির ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয় চুনাপাথর আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে কারখানার উৎপাদন তখন চলে আসে সর্বনিম্নে। সূত্র জানায়, পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কায় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পূর্ব খাসিয়া এলাকার বাসিন্দারা কয়েকটি এনজিওর পরামর্শে আদালতে মামলা করেন। ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির কারণে মেঘালয় রাজ্যের ননগোট্রাই খনি থেকে চুনাপাথর উত্তোলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন ভারতের হাইকোর্ট।

ফলে ২০০৭ সালের ১২ এপ্রিল থেকে খনি প্রকল্পে চুনাপাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। এতে লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানার লাভজনক মূল পণ্য ক্লিংকার উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে পড়ে। তখন কারখানা বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে ওই সময় কারখানার দেড় শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে স্বেচ্ছায় ছুটি প্রদান করা হয় এবং ছাঁটাই করা হয় কয়েকশ শ্রমিক।

২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় আদালতের একটি রায় লাফার্জের অনুকূলে যাওয়ায় কারখানাটি খনি প্রকল্প থেকে আবারও চুনাপাথর উত্তোলন করে উৎপাদন শুরু করে। কিন্তু একই অভিযোগে ২০১০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট খনি থেকে চুনাপাথর উত্তোলনের ওপর ফের নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ২০১১ সালের ৬ জুলাই দেশটির পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় লাফার্জকে সংশোধিত পরিবেশ বিষয়ক অনুমোদন দেয়।

এছাড়া আন্তর্জাতিক চুক্তির গুরুত্বের কথা বিবেচনায় এনে দীর্ঘ প্রায় ১৫ মাস পর ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এসএইচ কাপাদিয়া লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানার পক্ষে রায় প্রদান করেন।

এরপর থেকে লাফার্জ আবারও পূর্ণমাত্রায় ক্লিংকার ও সিমেন্ট উৎপাদন শুরু করে। কিন্তু সিমেন্ট তৈরির আরেকটি প্রধান উপাদান মাটি সংগ্রহে নতুন জটিলতায় পড়ে কারখানাটি। কারখানা কর্তৃপক্ষ কৃষিজমি থেকে স্থানীয়ভাবে মাটি সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ সময় কৃষিজমি থেকে মাটি না দেয়ার পক্ষে স্থানীয় লোকজন ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ জানান। কৃষিজমি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় স্থানীয় কৃষকরা তৎকালীন জেলা প্রশাসক জহির উদ্দিন আহমদের কাছে স্মারকলিপিও প্রদান করেন। তখন লাফার্জ কর্তৃপক্ষ স্থানীয় কৃষিজমির মালিকদের বিভিন্ন আর্থিক প্রলোভন দেখিয়ে জমি থেকে মাটি সংগ্রহ শুরু করে। এর ফলে প্রতি বছরই একের পর এক ফসলি জমি চলে যাচ্ছে লাফার্জের পেটে।

মাটি সংগ্রহের কারণে এলাকার কৃষিজমি পরিণত হচ্ছে জলাশয়ে। বাহ্যিক লাভে জমির উর্বর মাটি বিক্রি করে অনেক কৃষকই এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। অপরিকল্পিতভাবে মাটি বিক্রি করা এসব জমি বর্তমানে না-জলাশয় ও না-কৃষিজমিতে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় কৃষি জমির উপর লাফার্জ আগ্রাসন চালিয়ে এবং ক্লিংকার বিক্রি করে প্রতিবছর লাখ-লাখ মার্কিন ডলার আয় করছে। পাশাপাশি নোয়ারাই ইউনিয়নের বাতিরকান্দি, ঠেংগারগাঁও, জয়নগর, জোড়াপানিসহ বিশাল এলাকা বিরানভূমিতে পরিণত হচ্ছে।

এদিকে লাফার্জ সিমেন্ট কারখানায় ডাস্ট ডিভাইডার ব্যবহার না করায় আশপাশের সবুজ পরিবেশের মারাত্মকভাবে ক্ষতি হচ্ছে। কারখানার আশপাশের গাছপালা, ঘরবাড়ি এখন ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে। ১৭ কিলোমিটার কনভেয়ার বেল্টের উচ্চশব্দের কারণে ছাতক-দোয়ারা দু’ উপজেলার বেল্ট সংলগ্ন অর্ধশতাধিক গ্রামের মানুষ মারাত্মক শব্দদূষণে ভুগছেন। কনভেয়ার বেল্টের উচ্চশব্দের কারণে এসব এলাকার নারী-পুরুষ, শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা শব্দজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

বিষয়টি লাফার্জ কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার অবগত করা হলেও উচ্চশব্দ নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। অপরদিকে কারখানাটি সুরমা নদীর তীরে হওয়ায় কারখানা সংলগ্ন নদীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ অবৈধভাবে দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে রেখেছে লাফার্জ। একাধিকবার পরিবেশ দূষণ, শব্দ দূষণ, সুরমা নদী ভরাট ও স্থানীয়দের চাকরি নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও লাফার্জ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি কখনও আমলে নেয়নি। কথায় কথায় স্থানীয় শ্রমিকদের ছাঁটাই করা লাফার্জ কর্তৃপক্ষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। প্রচলিত নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে কয়েকটি ধাপে স্থানীয় অন্তত ৩ শতাধিক শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। চাকরিহারা এসব শ্রমিক ন্যায়বিচার ও চাকরি ফিরে পাওয়ার আশায় লাফার্জের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে মামলা করেছেন, যা বিচারাধীন।

২০১৩ সালের ৩ জুলাই স্থানীয় ফসলি জমির ক্ষতির বিষয়ে বোরো ল্যান্ড রিভাইটালাইজেশন প্রকল্পের আওতাধীন কৃষকদের সাফল্য মূল্যায়ন সভা করে লাফার্জ কর্তৃপক্ষ। সভায় ফসলি জমি থেকে মাটি সংগ্রহের বিষয়ে তীব্র সমালোচনা করেন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থার চেয়ারম্যান ও অতিরিক্ত সচিব জহির উদ্দিন আহমদ ও তৎকালীন সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ইয়ামিন চৌধুরী। তারা বলেন, মাটি সংগ্রহের বিষয়টি বিজ্ঞানসম্মত নয়।

এদিকে পাহাড়সম মাটি ডাম্পিংয়ের ফলে বসতঘরে ফাটল ও ফাটলজনিত কারণে প্রাণহানির অভিযোগ এনে ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছে। ২০১৪ সালের ১৩ এপ্রিল লাফার্জের প্ল্যান্ট ম্যানেজারের কাছে এবং মাটি ডাম্পিংয়ের কারণে ফসলি জমি অনাবাদি জমিতে পরিণত করার অভিযোগে নোয়ারাই এলাকার শুকুর মিয়া চৌধুরী ইউএনওর কাছে পৃথক অভিযোগ করেন। ১০ লক্ষাধিক টন মাটি ডাম্পিংয়ের কারণে ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ডাম্পিং সাইড সংলগ্ন এলাকায় ছাতক সিমেন্ট কারখানার ৬ ব্যারেল গ্যাস লাইনে বিকট বিস্ফোরণ ঘটলে ছাতক সিমেন্ট কারখানার উৎপাদন তখন বন্ধ হয়ে যায়।

কনভেয়ার বেল্টের উচ্চশব্দের কারণে ছাতক-দোয়ারার অন্তত ২০ থেকে ২৫ গ্রামের মানুষ শব্দজনিত নানা রোগে ভুগছেন। লাফার্জের মূল প্ল্যান্টের আশপাশের কয়েকটি গ্রামের সবুজ পরিবেশ সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। অতিরিক্ত ডাস্টের কারণে লাফার্জ সংলগ্ন সুরমা নদী হারাচ্ছে নাব্যতা। চুক্তি অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ভুমি মালিকদের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। লাফার্জের আশপাশের এলাকার ফসলি জমি ক্রমান্বয়ে চলে যাচ্ছে লাফার্জের পেটে। এক সময় এলাকার সব ফসলি জমি অনাবাদি জমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ-আপত্তির বিষয়ে লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানার কমিউনিটি রিলেশন কর্মকর্তা সাব্বির হোসেন জানান, বিশাল কারখানার বিষয়ে স্থানীয়দের অভিযোগ-আপত্তি থাকা স্বাভাবিক। আমরা যেকোনো ক্ষয়ক্ষতি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় এনে তা সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি। প্ল্যান্ট ম্যানেজার ই.আর.কিম স্থানীয়দের সমস্যার বিষয়ে এর আগে বলেছিলেন, লাফার্জের প্রতিষ্ঠাকালে স্থানীয়দের দেয়া সব প্রতিশ্রুতি তারা ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের ভূমির মূল্যসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ইতোমধ্যে দেয়া হয়েছে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই কারখানা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কিম বলেন, লাফার্জ সিমেন্ট কারখানা ছাতকে পরিবেশ বিপর্যয় করেই চলছে। দীর্ঘদিন ধরে তারা ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি কেটে নেয়ায় জমিগুলো এখন জলাশয়ের মতো হয়ে গেছে। তিনি বলেন, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, ফসলি জমি নষ্ট, নদী শাসনসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে লাফার্জের বিরুদ্ধে। পরিবেশবিদরা এক দশক ধরে এমন গুরুতর অভিযোগ করে এলেও সরকার এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn