রফিকুল ইসলাম কামাল :: বাবা-মা চেয়েছিলেন ছেলে আবদুস সামাদ ইঞ্জিনিয়ার হবে, তাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু মুখ উজ্জ্বল তো দূরে থাক, জঙ্গি হয়ে ছেলে বাবা-মাকে দুঃখের নীলনদে ভাসিয়েছে। পার্শ্বস্থ দেশ ভারতের কলকাতায় আবদু সামাদ সেখানকার পুলিশের হাতে জঙ্গি সন্দেহে আরো দুই সঙ্গিসহ গ্রেফতার হয়েছে। দেশটির পুলিশের বিশেষ টাস্ক ফোর্সের ধারণা, সামাদসহ গ্রেফতারকৃতরা জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদার সদস্য হতে পারে। কলকাতায় আবদুস সামাদ গ্রেফতারের পরই সুনামগঞ্জের ছাতকের জঙ্গিদের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এর আগেও ছাতকের একাধিক জঙ্গি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার ও নিহত হয়েছে।
জানা যায়, গত বছরের (২০১৬) ৮ অক্টোবর ঢাকার গাজীপুরের নোয়াগাঁও পাতারটেক এলাকায় র‌্যাব ও পুলিশের অভিযানে সাত জঙ্গি নিহত হয়। তন্মধ্যে একজন ছিল ছাতকের। সাইফুল ইসলাম বাবলু নামে ওই জঙ্গির বাড়ি ছাতক উপজেলার দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের মনিরগাতি গ্রামে। তার বাবা মতিউর রহমান দুঃখে-ক্ষোভে ওই সময় ছেলের লাশ আনতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার ছেলে জঙ্গি হয়েছে, এটা ভাবতে আমার কষ্ট হচ্ছে। সে দেশের শত্রু। আমরা তার লাশ আনবো না।’ মতিউর রহমানের তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে সাইফুল ছিল সবার বড়। গ্রামের বিদ্যালয়ে পাঠশালা শেষে ছাতকের সৈদেরগাঁও ইউনিয়নের পীরপুর শুকরুন্নেছা চৌধুরী স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছিল। ২০১২ সালে সিলেট সার্ক ইন্টারন্যাশনাল কলেজে ভর্তি হয়ে ২০১৪ সালে এইচএসসি পাস করে। ওই সময় সিলেট নগরীর খুলিয়াপাড়াস্থ তার ফুফুর বাসায় থাকতো সে। একই বছরের (২০১৬) ২৩ আগস্ট দিবাগত রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম টঙ্গিতে অভিযান চালিয়ে ব্লগার-লেখক-প্রকাশক হত্যায় জড়িত জঙ্গি মঈনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত ওরফে সামির ওরফে ইমরানকে গ্রেফতার করে। সিফাতের বাড়িও ছাতকে। ওই উপজেলার কালারুকা ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামের মৃত আবদুল কুদ্দুসের ছেলে সে।
জঙ্গি সিফাতকে ধরিয়ে দিতে দুই লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল পুলিশ। রাজধানীর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফীন দীপনকে কুপিয়ে হত্যার ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ ছিল এই সিফাত। তাকে গ্রেফতারের পর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেছিলেন, ‘সিফাত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন) সেকেন্ড ইন কমা-। সে বোমা চালানো এবং বিস্ফোরক তৈরিতে বিশেষ পারদর্শী।’ জঙ্গি সিফাত জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। সে সিলেট নগরীতে জামায়াত-শিবিরের নিয়ন্ত্রণাধীন শাহজালাল জামেয়া থেকে এসএসসি পাস করেছিল। পরে মদনমোহন কলেজ থেকে এইচএসসি ও ডিগ্রি সম্পন্ন করে। ২০১০ সালে ছাতকের গোবিন্ধগঞ্জ কলেজের পাশে নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরিরের লিফলেট বিতরণকালে গ্রেফতার হয়েছিল সিফাত। আট মাস জেল খেটে মুক্ত হয়েছিল সে। ছাতকে ‘জঙ্গি কারখানা’র সর্বশেষ সংযোজন আবদুস সামাদ ওরফে সামসেদ মিয়া ওরফে তানভীর। ছাতকের দোয়ারাবাজার ইউনিয়নের কাটাশলা গ্রামের কলমদর আলীর ছেলে সে। গেল মঙ্গলবার কলকাতা পুলিশের হাতে দুই সঙ্গিসহ গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে সেখানে রিমান্ডে আছে সামাদ।এক ডজন ভাই-বোনের মধ্যে ষষ্ঠ আবদুস সামাদ ছাতকের মঈনপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৯ সালে এসএসসি পাস করে। তাকে ইঞ্জিনিয়ার বানানো স্বপ্নে সিলেট পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ভর্তি করেন বাবা-মা। ২০১৪ সালে সেখান থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা শেষ করে সামাদ। এরপর বুয়েটে ভর্তি হওয়ার বাড়ি থেকে টাকা নিলেও তার ব্যাপারে তেমন কিছুই জানতো না পরিবার।
সিলেট পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে পড়াকালীন শিবিরের সাথে জড়িয়ে যায় আবদুস সামাদ। ওই সময় পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট শাখা শিবিরের সভাপতি মাহবুব আহমদের সাথে একই হলে থাকতো সে। কলকাতার গণমাধ্যম সেখানকার গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে জানাচ্ছে, আবদুস সামাদ আল কায়েদার সদস্য হতে পারে বলে গোয়েন্দারা ধারণা করছেন। তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে ব্লগারদের হত্যার টার্গেট নিয়েছিল সামাদ। ছাতকে একের পর এক জঙ্গির খবর বেরিয়ে আসতে থাকায় স্থানীয় পর্যায়ে আতঙ্ক রয়েছে। গোয়েন্দারাও এ বিষয়ে বাড়তি নজর দিচ্ছেন বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। তবে পুলিশ বলছে, বিভিন্ন স্থানে ছাতকের যেসব জঙ্গি ধরা পড়ছে, তাদের কোনো তৎপরতা নিজ এলাকায় ছিল না। সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার বরকত উল্লাহ খান বলেন, ‘বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সাথে ছাতকের যাদের সম্পৃক্ততা ছিল, তারা অন্যান্য এলাকায় নাশকতায় জড়িত থাকলেও নিজ এলাকায় কোনো অ্যাক্টিভিটি নেই।’

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn