বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে সামনে আরও কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে মন্তব্য করে বিভেদ ভুলে ‘জাতীয় ঐক্যের’ ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংখ্যায় ‘কম হলেও’ বিএনপির নির্বাচিতদের শপথ নিয়ে সংসদে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, তাদের প্রস্তাব ও সমালোচনার ‘যথাযথ মূল্যায়ন’ করা হবে। চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর গতকাল শুক্রবার জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।’ খবর বিডিনিউজের। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, এই ঐক্যের যোগসূত্র হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসামপ্রদায়িকতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সাম্য ও ন্যায়বিচার এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতি। তিনি বলেন, ‘বিজয়ের পর আমরা সরকার গঠন করেছি। সরকারের দৃষ্টিতে দলমত নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিক সমান। আমরা সবার জন্য কাজ করব। সরকারি সেবাখাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় জীবনের সর্বত্র আইনের শাসন সমুন্নত রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করব। জাতীয় সংসদ হবে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রবিন্দু।’

গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৫৭টি আসনে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। জোটগতভাবে তাদের আসন সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮৮টি। ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা তৃতীয়বারের মত সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে বিএনপিকে নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ভরাডুবি হয়েছে এবারের নির্বাচনে, সব মিলিয়ে তারা পেয়েছে আটটি আসন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘একাদশ সংসদে বিরোধীদলের সদস্য সংখ্যা নিতান্তই কম। তবে, সংখ্যা দিয়ে আমরা তাদের বিবেচনা করব না। সংখ্যা যত কমই হোক, সংসদে যে কোনো সদস্যের ন্যায্য ও যৌক্তিক প্রস্তাব/ আলোচনা/ সমালোচনার যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে। আমি বিরোধীদলের নির্বাচিত সদস্যদের শপথ নিয়ে সংসদে যোগদানের আহ্বান জানাচ্ছি।’ ২০০৯ সাল থেকে একটানা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে আসা শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধেও হুঁশিয়ারি উচ্চাররণ করেছেন তার ভাষণে। বলেছেন, ‘আমি জানি, দুর্নীতি নিয়ে সমাজের সর্বস্তরে অস্বস্তি রয়েছে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের নিজেদের শোধরানোর আহ্বান জানাচ্ছি। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা হবে।’ মাদক, জঙ্গি তৎপরতা এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অভিযানে সাফল্য পাওয়ার কথা তুলে ধরে তা অব্যাহত রাখা হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই। যেখানে হিংসা-বিদ্বেষ হানাহানি থাকবে না। সকল ধর্ম-বর্ণ এবং সমপ্রদায়ের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবেন। সকলে নিজ নিজ ধর্ম যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালন করতে পারবেন।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘দশ বছর আগের বাংলাদেশের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের ব্যবধান বিরাট, মানুষের জীবনমান এখন অনেক উন্নত। এখন মানুষ সুন্দর করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। দেশকে আমরা আরও উন্নত করতে চাই। তাই সামনে অনেক কাজ আমাদের। আরও কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে। আপনাদের সঙ্গে নিয়ে সেই বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে পারব, ইনশাআল্লাহ।’
প্রতি বছরের শুরুতে সরকারের বর্ষপূর্তির সময় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে নিজের পরিকল্পনা ও সরকারের অবস্থান জানিয়ে আসছেন প্রধানমন্ত্রী। তার এবারের ভাষণটি এল নতুন সংসদের অধিবেশন শুরুর ঠিক পাঁচ দিন আগে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে সরকার গঠনের সুযোগ দেওয়ায় ভাষণের শুরুতেই তিনি দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানান। শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা নৌকায় ভোট দিয়ে আমাদের বিজয়ী করেছেন আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। যারা আমাদের ভোট দেননি, আমি তাদেরও ধন্যবাদ জানাচ্ছি নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল দল ও জোট এবং প্রার্থীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
সকলের ‘অক্লান্ত পরিশ্রম ও সহযোগিতায়’ বিশাল এ জয় সম্ভব হয়েছে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের সকল নেতা-কর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের ধন্যবাদ জানান দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করায় নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। গত একদশকে বাংলাদেশের অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে মন্তব্য করে এর কৃতিত্ব শেখ হাসিনা দেন দেশের মানুষকে। আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় খুবই প্রত্যাশিত ছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে দেশি-বিদেশি জরিপগুলোতে এরকম আভাসই এসেছিল। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে গত দুই মেয়াদে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ এবং তার সাফল্যের চিত্র সবিস্তারে তুলে ধরেন। পাশাপাশি যেসব কারণে নির্বাচনে বিএনপির পরাজয় হয়েছে বলে তিনি মনে করেন, তার একটি তালিকাও তিনি দেন। তিনি বলেন, ‘বহু উদাহরণ দেওয়া সম্ভব, যার মাধ্যমে প্রমাণ করা যাবে যে সাধারণ ভোটারগণ বিএনপির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন এবং নৌকার অনুকূলে এবার গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল।’ জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা টানা তৃতীয়বার এবং ১৯৯৬ সাল থেকে চতুর্থবারের মত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে সরকার পরিচালনার ম্যান্ডেট দিয়েছেন। আপনাদের এবারের এই নিরঙ্কুশ সমর্থন আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাদের এই রায়কে দেশবাসীর সেবা এবং জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ শেষ করার ও সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ বলে মনে করি।’
শেখ হাসিনা এবার তার সরকার সাজিয়েছেন নতুনদের প্রাধান্য দিয়ে; তার মন্ত্রিসভার ৪৬ সদস্যের মধ্যে অধিকাংশই নতুন। এর কারণ ব্যাখ্যা করে জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি বলেন, ‘নবীন-প্রবীণের সংমিশ্রণে আমি আমার মন্ত্রিসভা গঠন করেছি। প্রবীণদের অভিজ্ঞতা আর নবীনদের উদ্যম- এই দুইয়ের সমন্বয়ে আমরা আমাদের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উদযাপনের সময় তিনি দেশকে আর্থ-সামাজিক খাতে এক অনন্য উচ্চতায় দেখতে চান। এর অংশ হিসেবেই ‘ভিশন ২০২১’ এবং ‘ভিশন ২০৪১’ বাস্তবায়নের কথা তুলে ধরে তিনি সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ ও আগামী দিনের পরিকল্পনার বিবরণ দেন ভাষণে। তিনি বলেন, জলবায়ুর ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন অর্জনের জন্য সরকার ‘বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ নামে শতবর্ষের একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সঙ্গে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রাগুলো সম্পৃক্ত করে তার বাস্তবায়ন ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজও সরকার শুরু করেছে। শিক্ষিত তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করাকে সরকার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বলে মনে করছে। সেজন্য বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে আর্থিক সহায়তা ও বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করা, তরুণ নারী উদ্যোক্তাদের বিশেষ সুবিধা ও প্রণোদনা দেওয়া, তরুণ উদ্ভাবকদের উদ্ভাবনগুলোর আন্তর্জাতিক পেটেন্টের ব্যবস্থা করা, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনবল গড়ে তোলার জন্য সরকার কাজ করছে। আগামি পাঁচ বছরে দেড় কোটি কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলেছে। সারাদেশে দুই ডজনের বেশি হাইটেক পার্ক এবং আইটি ভিলেজ নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। পাশাপাশি কৃষি, মৎস্য, পশুপালন, পর্যটন, সেবাখাতসহ অন্যান্য খাতে প্রাতিষ্ঠানিক এবং আত্ম-কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শেষ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিশেষ করে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মহেশখালি-মাতারবাড়ি সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পসহ ফার্স্ট ট্রাক মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন কাজে গতি আনা হচ্ছে। দেশের প্রতিটি গ্রামে শহরের সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেবে সরকার। প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেবে। ছেলেমেয়েদের উন্নত পরিবেশে লেখাপড়ার সুযোগ তৈরি করা হবে। সুপেয় পানি এবং উন্নতমানের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। সুস্থ বিনোদন এবং খেলাধুলার জন্য অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। ইন্টারনেট/তথ্য প্রযুক্তি সর্বত্র পৌঁছে যাবে। দেশের ভবিষ্যত কর্ণধার তরুণদের জন্য সরকারের পরিকল্পনার কথাও প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তারুণ্যের সৃষ্টিশীলতা, উদ্যম ও শক্তির ওপর তার পূর্ণ শ্রদ্ধা ও আস্থা রয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনারা আমার উপর আস্থা রেখে যে রায় দিয়েছেন, কথা দিচ্ছি আমি প্রাণপণ চেষ্টা করব সে আস্থার প্রতিদান দিতে। এজন্য দলমত নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিকের সমর্থন এবং সহযোগিতা চাই। আপনাদের সহযোগিতায় আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতামুক্ত অসামপ্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করব, ইনশাআল্লাহ।’
ভাষণের শেষে কবি সুকান্ত ভট্টাচাযের্র কবিতা থেকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি- নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn