ইমানুজ্জামান মহী-

সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের প্রতিনিধি সভা শেষ হলো ১৩ মার্চ রোববার। প্রতিনিধি সভায় বক্তাদের অনেকের দলের জেলা নেতৃত্বের উপর বিস্তর অভিযোগ করেছেন। তাদের বক্তব্যের ভাষা ছিলো বেশ আক্রমনাত্মক। এ যেন দলের জেলা সভাপতি ও সম্পাদকের উপর তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। হতে পারে তা প্রতিহিংসা কিংবা স্বার্থ হাসিল না হবার প্রতিক্রিয়া। এটাও হতে পারে নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দায়মুক্তির এক ব্যর্থ চেষ্টা। আর এসব কিছু না হলে হতে পারে যেন-তেন ভাবে বর্তমান নেতৃত্বকে সরিয়ে নিজেদের মতো করে নেতৃত্ব তৈরি করা।

সভায় নেতৃত্বের ব্যর্থতার অভিযোগ করে যারা বক্তব্য দিয়েছেন তাদের অযোগ্যতা বা ব্যর্থ কর্মকাণ্ড নিয়ে কারা অভিযোগ করবে? সেটাও একটা প্রশ্ন। এর পিছনে অন্য কোন বিরোধী শক্তির এজেন্ডা তারা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছেন কি না সে নিয়েও সন্দেহ থেকে যায়।

সদ্য সমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার ভরাডুবি নিয়ে বক্তাদের অনেকে কথা বলেছেন। তাদের অনেকের মতে পরাজয়ের মুল কারন নির্বাচনে ভুল প্রার্থী মনোয়ন। অভিযোগ প্রায় ক্ষেত্রে নৌকার প্রার্থী মনোনয়ন সঠিক হয়নি। প্রার্থী মনোনয়নের ব্যর্থতাকে তারা নের্তৃত্বের ব্যর্থতা বলছেন। এসব বলে সহজে নিজেদেরকে দায় মুক্ত করতে চাচ্ছেন। নিজেরা যে দলের পদ আগলিয়ে বসে আছেন। সে পদ নিয়ে কি করছেন? এ প্রশ্নের উত্তর কি তারা দিতে পারবেন?

আজকাল হচ্ছে প্রোপাগাণ্ডার যুগ স্যোসাল মিড়িয়ার যুগ। বিরোধী শক্তি প্রতিদিন সরকারের বিরোদ্ধে প্রোপাগাণ্ডা ওয়ার চালাচ্ছে। স্যোসালমিড়িয়া ব্যবহার করছে। প্রোপাগাণ্ডার কাছে শেখ হাসিনা সরকারের এতোএতো উন্নয়ন, অর্জন কোন কাজে লাগছেনা। দলের জনপ্রিয়তা যেখানে শীর্ষে থাকার কথা সেখানে দিনেদিনে তা তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। ক্ষমতায় বসে বাস্তবতাকে আমরা বেমালুম ভোলে আছি। শাঁক দিয়ে মাছ ঢাকার প্রাণান্তর চেষ্টা চালাচ্ছি। সরকারের অর্জনের কথা ফেসবুকে যদি আলোচনা করি কেউ এসে কমেন্ট বা সমর্থন দিতে চান না। মুখ লুকিয়ে থাকেন। অথচ আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডদের সবাই প্রায় একই রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী। এরা বিরুধী পক্ষের বিরাগভাজন হতে চান না। অন্তরে তাদের কাজ করে, যদি শেখ হাসিনার পতন হয় তা হলে সাইনবোর্ড পাল্টাতে যেনো সমস্যা না হয়। গাছের টাও এরা খেতে চায় নীচেরটাও চায়।

ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচনে নৌকার ভরাডুবির দায় কি শুধু ভুল প্রার্থী মনোনয়ন? এ দায় কি প্রতিটি দলীয় সদস্যের নয়? আমি সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির একজন সদস্য। দল পরিচলনার ব্যর্থতার দায়ভার যদি কিছু থেকে থাকে সে দায়ভার কিন্তু আমারও। দায়িত্ব অবহেলা কিংবা নৌকার ভরাডুবির পিছনে যদি আমার কোন দায়দায়িত্ব থেকে থাকে তাহলে আমার সদস্য পদ বাতিল হলে সে শাস্তি আমি মাথা পেতে নিবো।

ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচনে নৌকার ভরাডুবি একক ভাবে নেতৃত্বের উপর ছেড়ে দিলে হবে না। গোড়ায় গলদের কথাও ভাবতে হয়। দলের থানা ও ইউনিয়ন কমিটির বেহাল অবস্থা। অযোগ্য, অজনপ্রিয় নেতৃত্ব কি এ জন্য দায়ী নয়?

সাংগঠনিক ভাবে আওয়ামীলীগের সাথে অঙ্গ সংগঠন গুলোর ও দায় দায়িত্ব আছে। দলের জেলা কমিটির সকল সদস্যের কিছুনা কিছু দায়িত্ব আছে। সভাপতি ও সম্পাদকের উপর সব দায়িত্ব বর্তায় না। যদি তাই হতো তাহলে ৭১ সদস্য বিশিষ্ট আওয়ামীলীগের কমিটি বা অঙ্গসংগঠনের কি প্রয়োজন ছিলো? শুধু কি প্রতিনিধি সভায় মুজিবকোট, লম্বা ফিনফিনে পায়জামা পাঞ্জাবি আর গলায় প্রতিনিধি কার্ড ঝুলানো এদের দায়িত্ব ? না কি বিশেষ এক দিনে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সামনে এসে গলাবাজি করে দায়িত্ব পালন করা?

বর্তমান জেলা কমিটিতে অনেকে আছেন যাদেরকে আমি ছাত্রকাল থেকে চিনি এবং ভালো ভাবেই চিনি। এরা দলের বড়পদ যে কোন ভাবে ম্যানেজ করে নেয়। মহাসমাবেশ বা সাজানো সভামঞ্চের শ্রীবর্ধনকারী ছাড়া এরা আর কিছুনা। এরা সাজানো মঞ্চে প্রথম সারির চেয়ার দখলের ধান্দায় থাকে। এদেরকে আমি দেখে আসছি অনুষ্ঠানের দিন সকালে গোসল করে সব আয়োজনের শেষে ধবধবে দামী কাপড়ের পায়জামা, পাঞ্জাবির সাথে মুজিবকোটের উপর ইস্ত্রি করা কাশ্মীরি শাল গায়ে রিক্সা করে সভাস্থলে আসতে। রিক্সার সিটে দু’জনের বসার জায়গা থাকলেও এক সিট খালি থাকতো। খালি সিটে একজন কর্মী নিয়ে আসার যোগ্যতা এদের নেই। এরা এতো জনপ্রিয় যে, নিজেই নেতা। নিজেই কর্মী। যাকে বলে ‘ওয়ান বডি’ সর্বস্ব নেতা। যে দলে এদের মতো নেতা আছে সে দলে কর্মী অথবা সাপোর্টার কেন আসবে? মুখ দেখাতে না দেখতে? এ সব ফুলবাবুরা নির্বাচন এলে পদের জোরে মনোনয়ন চায়। টাকার জোরে কিংবা তদবিরে জোরে পেয়েও যায়।

জনপ্রিয়তা যাদের শূন্যের কোঠায় তাদের বেশির ভাগ নেতারা আজ দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এদের টাকা আছে। শক্তি আছে। প্রভাব আছে। এদের অনেকে আজ থানা ও ইউনিয়নের নেতৃত্বে। মন্ত্রী সাহেবের জোর। এমপি সাহেবের জোর। টাকার জোর। দলের জেলা সভাপতি, সম্পাদকের জোর। পদের জোরে সর্বোপরি কেন্দ্রীয় কমিটির কোন নেতার জোর। এক কথায় নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পাবার মতো যা জোর লাগে এদের সে জোর আছে। এসব জোরে এক সময় নির্বাচনে তারা নৌকা পেয়েও যায়।

এই ‘ওয়ানবডি’ শো নেতাদের কারনে থানায়, ইউনিয়নে, কিংবা জেলায় মেধাবী, ভালো মানুষরা রাজনীতিতে আসছেনা। ছিটেফোঁটা দু’একজন কস্মিনকালেও যাও আসে গ্রুপিং আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কুনুই গুঁতা খেয়ে কোনঠাসা হয়ে দল থেকে এরা ছিটকে পড়ে যায়।

কদাচিৎ দেখা যায় কোন ইউনিয়নে হয়তো জনপ্রিয় প্রার্থী নৌকা পেয়ে যায়। তার হয়তো টাকা জোর নাই। মন্ত্রীর জোর নাই। এমপির জোর নাই। এই জনপ্রিয় মানুষটা শেষমেশ হেরে যায়। ষড়যন্ত্রকারীরা নিজ স্বার্থ চিন্তায় গোপনে তার বিরোদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী দাড় করিয়ে নৌকার প্রার্থীর বারোটা বাজায়। শুধু প্রার্থীর বারোটা না দলের ও বারোটা বাজিয়ে দেয়।

আওয়ামীলীগের প্রতিনিধি সভায় কিছু বক্তার কথায় উঠে এলো জেলা কমিটির নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতার ফিরিস্তি। এসব ভুঁইফোড় বক্তারা দলের কাউন্সিল হলে। প্রতিনিধি সভা হলে শ্লোগান দিতে হায়ার করে লোক এনে নিজেদেরকে জনপ্রিয় করে তুলতে চায়। শোডাউন দিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদেরে প্রভাবিত করতে চায়। নিজের অযোগ্যতা ঢাকতে চায়।দায়িত্ব পালনে অযোগ্য হিসাবে পরিষদের বেশীর ভাগ সদস্যের অনাস্থা পায়। এরা আজকে একজনের কাল আরেকজনের। এদের চরিত্র। এদের অতীত রাজনৈতিক ইতিহাস সবার জানা।

আওয়ামীলীগ নয় শুধু এরা দলের অঙ্গসংগঠন গুলোও দখল করে রেখেছে। সে সব অঙ্গসংগঠন গুলোর কথা যদি বলি সে আরেক ইতিহাস। কোনকোন অঙ্গসংগঠনে তিন মাসের ক্ষমতা পেয়ে কোনকোন নেতা বছরের পর বছর ক্ষমতা কুক্ষিগত করে আছেন। বছর বছর পার হলেও তিন মাস মেয়াদ শেষ হয় না। পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয় না। থানা কমিটি, ইউনিয়ন কমিটি, ওয়ার্ড কমিটি হয় না। জড় পদার্থের মতো কার্যক্রম এক জায়গায় স্থিত হয়ে আছে। কেউ কিছু বলে না, এদের বিরোদ্ধে বলার মতো বুকের পাটা কারুর আছে কি না জানিনা।

আজকে সময় এসেছে দলকে নিয়ে ভাবার। নেতৃত্বের শুধু পরিবর্তন নয়। ওয়ানবডি শো নেতাদের চিহ্নিত করার। থানা, ইউনিয়ন,,ওয়ার্ড পর্যায়ে শুধু আওয়ামীলীগকে নয় প্রতি অঙ্গসংগঠনকে ও শক্তিশালী করে তুলতে হবে। ত্যাগি ও জনপ্রিয় নেতৃত্ব সামনে নিয়ে আসতে হবে।

লেখক -ইমানুজ্জামান মহী কার্যকরী সদস্য সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগ। লন্ডন ১৪-০৩-২০২২ ইং।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn