ঘরটাতে ঢুকতেই চোখে পড়ে বড় বড় ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। শো-কেজের ওপর সাজানো নানারকম পুরস্কার, কোনটা রচনা প্রতিযোগিতার কোনটা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় পাওয়া। পড়ার টেবিলটাও আগের জায়গাতেই আছে, স্থান পরিবর্তন হয়নি। টেবিলটায় শুধু নেই তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। ত্বকীর কক্ষটি এখন ব্যবহার করা হয় অতিথিদের বসার কক্ষ হিসাবে। তবে ছেলের পড়ার টেবিল, বিছানা আগের মতোই রেখেছে ত্বকীর পরিবার।নারায়ণগঞ্জ নাম শুনলেই মনে পড়ে এক সময়ের আলোচিত ত্বকী হত্যাকাণ্ডের কথা। ত্বকী হত্যাকাণ্ডের চার বছর পূর্ণ হলো আজ। কিন্তু ত্বকী হত্যা মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। ত্বকী হত্যা মামলা ও নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি নিয়ে পরিবর্তন ডটকমের সাথে কথা হয় ত্বকীর বাবা রাফিউর রাব্বীর সাথে।ছেলেকে নিয়ে কথা বলতে বলতে একসময় চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে রাব্বির, বলতে থাকেন ছেলের নানা সাফল্যের কথা। আবার মুহূর্তেই চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে বিষাদ। রাফিউর রাব্বির, এখনো ছেলে হত্যার বিচার না হওয়ার পেছনে সরকারকে দায়ী করেন।তিনি বলেন, ‘তদন্তকারী সংস্থা ত্বকী হত্যায় আজমেরী ওসমানের জড়িত থাকার কথা নিশ্চিত করার পরও আজমেরি ওসমানের বাবা নাসিম ওসমানের মৃত্যুর পর সরকারের পক্ষ থেকে যখন সংসদে দাঁড়িয়ে ওসমান পরিবারের পাশে থাকার কথা ঘোষণা করেন তখনই ত্বকী হত্যার বিচারের মোড় ঘুরে যায়।’

‘বিচারের কার্যক্রম সেই অর্থে তখনই বন্ধ হয়ে যায়’, ক্ষোভ ঝরে সন্তান হারানো রাব্বির কণ্ঠে। ২০১৪ সালে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান সংবাদ সম্মেলন করে আজমেরী ওসমানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। তবে এ নিয়ে কোনো অভিযোগপত্র এখনো জমা দেওয়া হয়নি আদালতে।

সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, ত্বকী হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়। তবে আদালতের সেই আদেশের ১০ মাস ফেরিয়ে গেলেও কোনো সাড়া নেই তদন্তকারী কর্মকর্তার পক্ষ থেকে। ‘আইনগত জটিলতার কারণে ত্বকী হত্যার বিচার আটকে আছে বলে মনে করেন না রাফিউর রাব্বী।  তার মতে, ‘যখন রাষ্ট্রের  সর্ব্বোচ্চ পর্যায় থেকে তাদের (আসামীদের) পাশে থাকার, পক্ষে থাকার কথা বলা হয় তখন তাদের(আসামিদের) বিরুদ্ধে বিচার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলবে এমন মনে করার কোন কারণ নেই।’

ওসমান পরিবার সম্পর্কে রাফিউর রাব্বী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যখন সরকারে থাকে তখন তারা দেশে থাকে, আওয়ামী লীগ যখন সরকারে থাকে না তখন তারা দেশ ছেড়ে চলে যায়।’তবে তিনি আশা করেন, এ সরকারের মেয়াদেই তিনি সন্তান হত্যার বিচার পাবেন। তাবে রাফিউর এও রাব্বী বলেন, ‘যদি তারা (সরকার) এই বিচারটা নাও করেন তাহলেও আমি বিশ্বাস করি এই বিচারটা কোনো না কোনোদিন অবশ্যই হবে। এবং যারা অপরাধী তাদের সাথে সাথে এই বিচারটা বিলম্বিত করার জন্য যারা জড়িত তাদেরও বিচারের কাঠগড়ায় আসতে হবে।

রাফিউর রাব্বীর কথায় তার ছেলে হত্যার বিচার আটকে আছে রাষ্ট্রের সর্ব্বোচ্চ ব্যক্তির আসামিদের পাশে থাকার ফলে তাহলে তিনি আবার কি করে ছেলে হত্যার বিচার পাবেন বলে আশা করেন এমন প্রশ্নে রাফিউর রাব্বী বলেন, ‘আমি বিচারটা এজন্য প্রত্যাশা করি কারণ রাষ্ট্রের অভিভাবক বা পরিচালক যারা তাদের অবস্থান সবসময় একরকম থাকে না। তাদের বোধোদয় হবে এবং তারা একসময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিবেন।’

ঘটনার শুরু ২০১৩ সালে। ওই বছরের ছয় মার্চ তারিখে নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও ২০১১ সালের সিটি মেয়র নির্বাচনে সালিনা হায়াত আইভীর পক্ষে কাজ করা রাফিউর রাব্বির প্রথম সন্তান ত্বকী নিখোঁজ হয়। নিখোঁজ হওয়ার দুইদিন পর ৮ মার্চ তারিখে ত্বকীর মৃতদেহ শীতলক্ষ্যা নদীতে পাওয়া যায়। খুন হওয়ার সময় ত্বকী এ লেবেলের শিক্ষার্থী ছিল। এ লেবেল পরীক্ষার ফল প্রকাশের অপেক্ষায় থাকা ত্বকী জানতে পারেনি নিজের অসাধারণ ফলাফলের কথা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে নিখোঁজের পরদিন এ লেবেল পরীক্ষার প্রকাশিত ফলাফলে ত্বকী সারাদেশে সর্ব্বোচ্চ পদার্থ বিজ্ঞানে ৩০০ নম্বরের মধ্যে ২৯৭ নম্বর অর্জন করেছিলো।

হত্যা মামলা দায়েরের পর ২০১৩ সালের ১৮ মার্চ শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, যুবলীগ নেতা পারভেজ, জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি রাজীব দাস, সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান, সালেহ রহমান সীমান্ত ও রিফাতকে দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সুপারকে একটি অবগতিপত্র দেন ত্বকীর বাবা রাব্বি।

২০১৩ সালের ৭ অগাস্ট শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরি ওসমানের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে একটি রক্তমাখা প্যান্টসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র উদ্ধার করে র‌্যাব। সেখানেই ত্বকীকে আটকে রেখে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে বলে রাব্বি অভিযোগ করলেও শামীম ওসমান বরাবরই এর সঙ্গে তার পরিবারের সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।এরপর ২০১৪ সালের মার্চে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, ত্বকী হত্যাকাণ্ডে আজমেরী ওসমানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে।

রাফিউর রাব্বী অভিযোগ করেন, ‘শুধুমাত্র একটা পরিবারের কারণেই নারায়ণগঞ্জের সব অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ, সেটা হলো ওসমান পরিবার।’ নারায়ণগঞ্জের সব ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, হত্যা, চাঁদাবাজি সবকিছুই এই পরিবারের লোকেরা করে বা তাদের লোক দিয়ে করায় বলেও দাবি করেন রাব্বি। শুধু ত্বকী নয় আর অনেককেই হত্যা করা হয়েছে ওসমান পরিবারের টর্চার সেলে। কিন্তু তারা কখনো বিচারের মুখোমুখি হয় নাই বরং তাদের বিভিন্ন সময়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে বলে হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn